Islamic stories-ইসলামিক গল্প (part 3)
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
গল্পে গল্পে জীবন
(দোস্তহুজুর)
(part 3)
(part 3)
জামাতে শশুম (কাফিয়া)-এর বছর শোকের সাগরে ভাসিয়ে মা মারা গেলেন। খালা চেয়েছিলেন মা-মরা বোনপোকে নিজের কাছে নিয়ে রাখবেন। ঢাকায় কোনও মাদরাসায় ভর্তি করিয়ে দেবেন। বাবা বাদ সাধলেন। মা যতদিন বেঁচে ছিলেন, খালাবাড়ির সাথে গভীর সম্পর্ক ছিল। আসা-যাওয়া ছিল। মা-খালার ইচ্ছার ব্যতিক্রম কিছু ঘটবে, এমনটা কল্পনাতেও ছিল না। পাত্র-পাত্রীও সেভাবে বেড়ে উঠছিল। বোন মারা যাওয়ার পর, দু’পক্ষের আসা-যাওয়া কমে গেল। মেয়ের মাধ্যমিক পরীক্ষার পর খালুজি যোগাযোগ করেছিলেন। ছেলেকে ঈদে বেড়ানোর জন্য ঢাকায় পাঠানোর অনুরোধ করেছিলেন। আব্বু নিজ বিবেচনায়, শালীর আহ্বানে সাড়া না দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত মনে করেছিলেন। আমার মনে ছটফটানি ছিল খালাত বোনের প্রতি। বয়েস কম। সুন্দর ও চাকচিক্যের প্রতি সহজাত আকর্ষণ থাকেই সে বয়েসে। তাছাড়া খালাও অনেক আদর করতেন। ঢাকায় যাওয়ার জন্য গোছগাছও শুরু করেছিলাম। বাবাকে নিস্পৃহ দেখে, আগে বাড়তে সাহস হয়নি। বাবার এককথা, ‘মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করো। এখন বেড়ানার সময় নয়’।.
খালা আরও কয়েকবার চেষ্টা করে ক্ষান্ত হয়েছিলেন। বুঝে ফেলেছিলেন, বোন মারা যাওয়ার পর, দুলাভাই আর এই সম্পর্কে আগ্রহী নন। পরে খোঁজ নিয়ে দুলাভাইয়ের গররাজির কারণ, উদ্ধার করেছিলেন। তাদের মধ্যে ধার্মিকতা কম। কথাটা খালাকে আঘাত করল। তার মেয়েকেও ছুঁয়ে গেল। সরল-সোজা হুজুর খালাত ভাইয়ের প্রতি তার মনেও বেশ কিছুটা জায়গা তৈরি হয়ে ছিল। মেয়েদের মন বড় অভিমানী। স্কুলে পড়লে বুঝি ধার্মিক হয় না? মা-মেয়ে দু’জনই প্রতিজ্ঞা করল, পছন্দের জায়গায় বিয়ে যখন হল না, পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। যতটা সম্ভব ধর্মপালন করেই।
.
আব্বুর চিন্তাটা সময়ের বিচারে যৌক্তিক ছিল। স্ত্রী বেঁচে থাকলে, বিয়েটা হতোই। পরিবারের প্রায় সবার বিপরীতে যাওয়াটা আব্বুর জন্য কঠিন ছিল। মা মারা যাওয়ার পর, দুই পরিবারের সম্পর্কেও ফাটল ধরবে, ভায়রার সাথে, শালীর সাথে, সাথে মনোমালিন্য হবে, এসব কিছুরই পরোয়া করেননি। ছেলের মনও বোধহয় ওদিকে ঝুঁকে আছে। সেটাও তার কাছে গুরুত্ব পেল না। তিনি হেকমতের সাথে অগ্রসর হলেন।
.
খালা রাজি হলেও, খালু এখানে বিয়ে হওয়ার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। তার যুক্তি ছিল, মেয়ে শহরে বেড়ে উঠেছে। পড়াশোনা করেছে স্কুলে। ছেলে আগাগোড়া গ্রামে বেড়ে উঠেছে। দু’জনের মনের মিল হওয়া নিয়ে সন্দেহ আছে। ছেলের একটা মেজর অপারেশনও হয়েছে। মেয়েকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়াটা যুক্তিযুক্ত আচরণ হবে না। স্বামীর অনাগ্রহ দেখে, স্ত্রীও ক্ষান্ত হলেন। কিন্তু পাত্রীর মনে তখনো আগ্রহ থেকে গিয়েছিল। ঈদের সময় নানাবাড়িতে এসে, একফাঁকে নানুকে নিজের দুর্বলতার কথা জানিয়েছে। বড়ামামিকেও বলেছে। আবার বিয়ের প্রচেষ্টা চলল। সফল হল না। আল্লাহর ইচ্ছা ছিল না। বড়ভাই এরপর ভয়ে নানাবাড়ি যাওয়া বন্ধ কর দিলেন। যদি খালাত বোনের সাথে দেখা হয়ে যায়? নিজের ইচ্ছার উপর জোর খাটিয়ে বাবার সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিয়েছেন। পৃথিবীটা গোল। ঘুরেফিরে মুখোমুখি হতেই হয়।
.
ভাই যখন মিশকাতে পড়েন, আরেকটা প্রস্তাব এল। বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দীর্ঘদিন ধরে একসাথে তাবলীগ করে আসছেন। আমীর সাহেব বড় আগ্রহ করে নিজের মেয়ের জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন। নিজের মেয়ের জন্য কেউ এভাবে পাত্রের বাবার কাছে প্রস্তাব দেন না। আশেপাশে আলেম নেই। আমীর সাহেবের বড় আগ্রহ, একজন আলেম পাত্রের কাছে মেয়েকে পাত্রস্থ করবেন। মেয়েটা বড়ই সুশীলা। দ্বীনদার। ঘরেই কিছুদূর পড়েছে। স্কুলে যায়নি। মায়ের কাছেই পড়াশোনা যা করার করেছে। ঘরের কাজকর্ম শিখেছে। শুদ্ধ করে কুরআন পড়তে শিখেছে। নিজ আগ্রহে কিছুটা মুখস্থও করেছে। আমীর সাহেব অবিশ্যি এবারই প্রথম প্রস্তাব দেননি। বড়ভাই যখন হেদায়া জামাতে পড়েন, তখনও একবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বাবা এবারের প্রস্তাবে সাড়া দিলেন। বাবা রাজি হলেও, ভাই দৃঢ়সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিলেন, পড়ালেখা শেষ না করে বিয়ে করবেন না। আমীর সাহেব শুরু থেকেই হাল ছাড়েননি। নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। ছেলের খোঁজ রেখেছেন। প্রয়োজনে-তাকিদে পাশে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। মেয়ে আর বিবিকে নিয়ে এ-বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। ভাইকেও দাওয়াত দিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেছেন। সম্পর্ক করার জন্য অনেক আগে থেকে জোর প্রস্তুতি চালিয়ে গেছেন।
.
দাওয়া পাশ করার পর বিয়ের প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হল। ছেলে চুপচাপ। তার মনে বোধ হয় এখনো খালাত বোন ঢুকে বসে আছে। বাবা বুদ্ধি করে ছেলের সবচেয়ে ওস্তাদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। তার কাছে পাত্রীর অবস্থা সবিস্তারে তুলে ধরলেন। হুজুর ইস্তেখারার জন্য তিনদিন সময় নিলেন। সিদ্ধান্ত এল আমীর সাহেবের মেয়ের সাথে বিয়ে হলেই বেশি ভাল হবে বলে মনে হয়।
.
শ^শুর সাহেব ছাত্রযমানায়ই আব্বুর কাছে প্রস্তাব দিলেও, আব্বু কারও কাছে কথাটা ভাঙেননি। কাউকে না জানিয়ে তখনকার মতো প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। আমার মায়ের মনে কষ্ট দিতে চাননি হয়তোবা। মায়ের যে খুউব ইচ্ছে ছিল, বোনজিকে পুত্রবধূ করে ঘরে তুলবেন। মেশকাতের বছর আমি বড় হয়েছি, তাই আব্বু প্রস্তাবের কথা নতুনমাকে দিয়ে জানিয়েছেন। তখনো আমার ধারণা ছিল, খালাত বোনের সাথেই আমার বিয়ে হবে। প্রস্তাব পাওয়ার পর বুঝতে পেরেছি, আব্বুর ইচ্ছে ভিন্ন। রেহানার সাথে বিয়ের প্রস্তাব পাওয়ার পর, বুঝতে পেরেছি, আব্বু কেন আমাকে রেহানাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ব্যপারে এত আগ্রহ দেখাতেন। আব্বু কোথাও দাওয়াত খেতে যেতেন না। আমাকেও যেতে দিতেন না। শুধু এই তার তাবলীগি সাথী ভাইয়ের বাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারে একপায়ে খাড়া ছিলেন। আমি বাড়িতে থাকলে, সাথে করে নিয়ে যেতেন। পরে ভেবে দেখেছি, দাওয়াতগুলোও সেভাবেই আসত। মাদরাসা ছুটিতে বাড়ি এসেছি, তখন ও-বাড়ি থেকে দাওয়াত এসেছে। আব্বু আমাকে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করে, খালাত বোন থেকে সরিয়ে এনেছেন। সরিয়ে এনেছেন, বলতে তার সাথে বিয়ের কথাবার্তা অঘোষিতভাবে হওয়ার কারণে, খালাত বোনের প্রতি বাড়তি আগ্রহ তৈরি হয়েছি, এটুকুই।
.
রেহানাদের বাড়িতে প্রতিবারের দাওয়াতে এলাহি আয়োজন থাকত। সবাই আমাকে এত গুরুত্ব দিত, মাছের বড় টুকরাটা, গোশতের বড় ‘খ-টা’ আমার পাতে তুলে দিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ত। ভেতর থেকে একটু পরপর এটাসেটা নাস্তা আসত। মাদরাসা ছিল রেহানাদের বাড়ির কাছে। আম্মু মারা যাওয়ার পর থেকে, আমার (ভবিষ্যত) শাশুড়ী মাঝেমধ্যে আমার জন্য ভাত-তরকারি পাঠাতেন। তখন মনে করতাম, আব্বুর বন্ধু হিশেবে পাঠাচ্ছেন। হয়তো সেজন্যই পাঠিয়েছেন। মা-মরা ছেলেটার প্রতি বাড়তি মায়া জন্মানো বিচিত্র কিছু নয়।
.
রেহানাদের বাড়িতে বেড়াতে গেলে, আব্বু আমাকে বয়ানে লাগিয়ে দিতেন। প্রথম প্রথম হোঁচট খেলেও, পরে পরে দিব্যি মুখ চালু হয়ে গিয়েছিল। তাবলীগের হালকাগুলোতে, শবগুজারিতে, জোড়ে আব্বু আমার বয়ানের জন্যে সুযোগ তৈরি করে রাখতেন। একদম ছোটবেলা থেকেই আমাকে মিম্বরে বয়ানে বসাতেন। রেহানাদের বাড়িতে বয়ান করতে গেলে, ভেতরবাড়িতে মহিলাদের ভীড় লেগে যেত। বয়ানগুলো যে আহামরি গোছের কিছু হত, তা নয়। তখনকার দিনে গ্রামে এত ওয়াজ-মাহফিরের চল ছিল না। তাই হুজুর পেলেই বাড়িঘরে খুসুসী বয়ানের ব্যবস্থা করা হত। মা-বোনেরা অত্যন্ত আগ্রহের সাথে বয়ানে শরীক হতেন। একেকটা বয়ানের প্রভাব হত সুদূরপ্রসারী। মা-বোনদের দ্বীনশিক্ষার প্রধান মাধ্যমও ছিল এই খুসুসী বয়ানগুলো।
.
বিয়ের পর দুই বছর পর্যন্ত বিবিকে ঘরে তুলতে পারিনি। ঘরদোর ঠিক ছিল না। পর্দা-পুশিদামতো চলার উপায় ছিল না। এজন্যই আমি এত সাততাড়াতাড়ি বিয়ে করতে গররাজি ছিলাম। শ^শুরের চাপাচাপিতে বিয়ে করতে হয়েছে। আমি সমস্যার কথা বললে, তিনি বলেছেন, অসুবিধে নেই, যথাযথ ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত মেয়ের সার্বিক যিম্মা আমাদের কাছে থাকবে। আর কোনও কথা থাকে না। বিবি প্রথম দু’টি বছর শ^শুরবাড়িতে থাকাতে, আমার কত যে উপকার হয়েছে, বলে শেষ করা যাবে না।
.
ভাইবোনের প্রতি, আত্মীয়-স্বজনের প্রতি ভাই অত্যন্ত দরদী আচরণ করতেন। আপন মা মারা যাওয়ার পর, বাবা আবার বিয়ে করেছিলেন। নতুন মাকেও ভাই অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন। বাবার মৃত্যুর পর, নতুনমাকে পরিপূর্ণ যত্নের সাথে নিজের সংসারে রেখেছেন। সৎমায়ের খেদমতে ভাই কোনওরকমের কসুর করতেন না,
‘আমার সৎমা অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। আপন মায়ের মতোই আদর-যত্ন করেছেন। আমরাও মায়ের যথাযথ সম্মান-কদর করার চেষ্টায় কসুর করতাম না। আমাদের দু’জন সৎ বোন ছিল। একজনের বিয়ের ব্যবস্থা আব্বা নিজে করে গেছেন। আব্বা মারা যাওয়ার সময় দ্বিতীয় বোন তখনো ছোট। আব্বা বারবার সৎমা আর সৎবোনের ব্যাপারে ওসীয়ত করে গেছেন। আমরা সব ভাইয়েরা মিলে চেষ্টা করেছি, বোনকে লেখাপড়া শেখাতে। অন্য ভাইয়েরা ক’দিন পর বোনের লেখাপড়ার ব্যাপারে উৎসাহ হারিয়ে ফেললেও, আমি হাল ছাড়িনি। ছোটভাই একদিন রাগের মাথায় সৎবোনের গায়ে হাত তুলেছিল, আমি তাকে কঠিন করে শাসিয়ে দিয়েছি। বোনের বিয়ের বয়েস হয়েছে। ভাইরা খরচের ভয়ে বা অন্য কোনও কারণে বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল না। আমি উদ্যোগী হয়ে পাত্র খুঁজতে নামলাম। পেতে দেরী হল না। ছেলে ভাল আলেম। ঢাকার এক মাদরাসায় শিক্ষকতা করে। কপালে একটু কাটা দাগ, এছাড়া আর কোনও সমস্যা নেই। পাত্রের দিক গুছিয়ে, মা আর বোনকে পাত্র সম্পর্কে বিস্তারিত বললাম। বোনের মতামত চাইলাম। বোন চমৎকার উত্তর দিয়েছিল,
-আপনি আর ভাবী মিলে আমাকে যদি সাগরেও ভাসিয়ে দেন, আমি তাতেও রাজি।
তারপরও পাত্র-পাত্রীর দেখার ব্যবস্থা করলাম। উভয়পক্ষই পছন্দ করল। বিয়ের পর এক দরদী (!) আত্মীয় কথা তুলল,
-বাবা মারা গেছে বলে কি, বোনকে একজন কপালকাটার হাতে তুলে দিতে হবে? বাবা থাকলে কি এমনটা ঘটতে দিতেন?
এতদিন এসব আত্মীয়ের কোনও খোঁজ-খবর ছিল না। এখন তাদের দরদ উথলে উঠছে। বোনটা এখন কী যে সুখি! স্বামীর সাথে ঢাকায় থাকে। ভাইয়ের জন্য সবসময় দোয়া করে। ভাই উদ্যোগী না হলে, এত ভাল স্বামী তার কপালে জুটত না। বোনের কথা হল, কপাল কাটা? সে তো চামড়ার উপরে। তার মনটা যে সম্পূর্ণ অক্ষত! সেটা অন্যরা কীভাবে বুঝবে? ভাইয়া-ভাবীর উপর শতভাগ আস্থা রেখে আমি ঠকিনি। তারা দু’জন আমার জন্য যা করেছেন, লেখাপড়ার খরচ চালানো থেকে শুরু করে বিয়ের পর পর্যন্ত, আপন ভাইয়েরাও অনেকসময় এতটা করে না।
ভাই খুবই গরীব, তবুও নিয়মিত বোনের খববাখবর রাখেন। বিয়ের পরও নিয়মিত এটাসেটা হাদিয়া পাঠানোর চেষ্টা করেন। বাচ্চাকাচ্চা হলে, রসম-রেওয়াজ মেনে পিঠা-কাঁথাবালিশ পাঠান। ভাইয়ের কাছে একজন বাপহারা বোনের এর বেশি আর কী চাওয়ার থাকে?
Please VIsit Our Website for Part 4
কোন মন্তব্য নেই