Islamic stories-ইসলামিক গল্প (part 5)
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
গল্পে গল্পে জীবন
(দোস্তহুজুর)
(part 5)
ভাইয়ের জীবনটা যেন কুরআন ও সুন্নাহর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। সারাবিশে^ হাজারো কওমী মাদরাসা। মিশকাত শরীফ কত মুহাদ্দিসই তো পড়ান। ভাইয়ের মতো এভাবে মেশকাতের প্রতিটি হাদীসকে জীবনের অন্দর পর্যায়ে আমলে নিয়ে আসনে কজন? জালালাইন পড়ান,এমন মুফাসসিরেরও অভাব নেই। কিন্তু সারাক্ষণ, হাটতে-চলতেও জালালাইনকে ধারণ করেন ক’জন?
.
তার পীর সাহেব তাকে ‘ইজাযত’ দিয়েছেন। বয়াত করানো শুরু করতে বলেছেন। ‘আমি কী বায়য়াত করাবো’ আমার হযরত এখনো জীবিত। আমার ভেতরটা এখনো নানা ‘গান্দা’ দ্বারা কলুষিত। পীর সাহেব হবেন, স্বচ্চ আয়নার মতো। মুরীদ তার কাছে এসে, নিজের দুর্বল দিকগুলো শায়খের আয়নার দেখবে। নিজেকে শোধরাবে। পীরের মধ্যেই যদি ‘নাপাকি’ থাকে, মুরীদ পাক হবে কীভাবে? পীর বেদাতি হলে, মুরিদও বেদাতি হবে। পীর ভিক্ষুক হলে, মুরীদও ভিক্ষুক হবে। পীর অশুদ্ধ হলে, মুরীদ কীভাবে বিশুদ্ধ হবে? আসল কথা হল, নিজের পাশাপাশি মানুষের হেদায়াতের ফিকির করা। সেটা আমি টুটাফাটা চেষ্টা করে যাচ্ছি। তার জন্য পীর সেজে বয়াত করার প্রয়োজন নেই। হেদায়াতের মালিক আল্লাহ। আমার শায়খের ইন্তেকালের পরও যদি আল্লাহ তা‘আলা হায়াতে রাখেন, তখন দেখা যাবে।
.
বয়েস বাড়তে বাড়তে, একেকজনের চিন্তায় একেকদিন প্রাধান্য পেয়ে যায়। বড় ভাইয়ের মধ্যে আল্লাহর ভালোবাসা আর কুরআনের চিন্তা প্রাধান্য পেয়েছে। যে কোনও আয়াত শোনার সাথে সাথে, বলে দিতে পারেন, এটা কোন ঘরানার। এখানে আল্লাহ কী বলেছেন, আমাদের জন্য কী শিক্ষণীয় বিষয় আছে। সবকিছুতে তিনি আল্লাহর কুদরত বের করে ফেলতে পারেন। এক দুর্লভ গুণ। যে মানুষ বলতে পারে, আল্লাহর জন্য তার সবসময় ‘পরান হোড়ে’ মানে প্রাণ কাঁদে, সে মানুষের চিন্তাজুড়ে আল্লাই থাকবেন, এ আর বিচিত্র কি!
.
ভাইয়ের কথা শুনে মনে মনে বলি, দরকার নেই আপনার পীর হয়ে। এমনিতে আপনি একার হাতে যা করছেন, প্রথাগত দশটা পীরের পক্ষেও তা সম্ভব হত কি না, ঘোরতর সন্দেহ আছে। আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে দিয়ে কাজ নিচ্ছেন। কত মানুষ আপনার কাছে দ্বীন শেখার সুযোগ পাচ্ছে। এ কম কথা!
.
ফাঁক পেলেই ভাবীর সাথে গুটুর গুটুর কথা বলতে শুরু করেন। প্রতিবার কথা শেষ করে মোবাইল আবিষ্কারকারীর জন্য হেদায়াতের দোয়া করতে ভোলেন না। দু’জনের এমন রসঘন প্রেমময় সম্পর্ক দেখে, একদিন জানতে চাইলাম,
- আপনাদের কখনো ঝগড়া বা মনোমালিন্য হয়নি?
-‘হয়েছে। ঝগড়া মনোমালিন্য ছাড়া সংসার হয় নাকি। কিন্তু রেহানার একটা অসাধারণ গুণ হল, সে যতকিছুই হোক, সাথে সাথে গিলে হজম করে ফেলতে পারে।
আরেকটা ব্যাপার, আমি সবসময় বিপদজনক পরিস্থিতিতে থাকি। আমার ছাত্রীরা বড় হয়েছে। ছাত্রের বউরা আছে। তারা নানা প্রয়োজনে আমার কাছে আসে। আমারও নানা কাজে তাদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়। শয়তান চারপাশে ঘোরাঘুরি করে। আমি টের পাই। ইবলীস শুধুই সুযোগ খোঁজে। কীভাবে আমাকে ফাঁদে ফেলতে পারে। এমন জীবন্ত ফিতনার মাঝে গুনাহমুক্ত থাকতে হলে, আমার শক্তিশালী একটা আশ্রয়কেন্দ্র (এন্টিভাইরাস) দরকার। বিবিকে আল্লাহর আমার জন্য জান্নাত বানিয়ে পাঠিয়েছেন। জান্নাত যেমন পূত-পবিত্র, বৃষ্টির পানি যেমন নিষ্কলুষ, আমার বিবিও তেমন। আল্লাহর ঘোষণা দেয়া হালাল। পবিত্র। বিবির সাথে মনোমালিন্য খুব কমই হয়, হলেও সাথে সাথে হজম করে ফেলি। এই ফিতনার যমানায়, বিবি আমার জন্য শক্তিশালী এক দুর্গ।
.
মাঝেমধ্যে ঢাকায় আসতে হয়। ঢাকায় কত আত্মীয়-স্বজন থাকেন, কারও বাসায় যেতে ভাইয়ের মন সায় দেয় না। তার কাছে মাদরাসার পরিবেশই ভাল লাগে। পরিচিত কোনও মাদরাসাতেই রাতটুকু কাটিয়ে দেন। আপন খালা থাকেন ঢাকায়, সেই যে বিয়ে ভেঙে গেছে, তারপর থেকে লজ্জায় হোক বা অন্য কোনও কারণে হোক, খালার বাসায় যেতে সংকোচ বোধ হয়। তিনি জানতেন, তার সাথে বিয়ে না হওয়াতে খালা ও খালাত বোন উভয়েই ভীষণ মর্মাহত হয়েছে।
.
ভাই একবার মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। নিজের জেলাশহরের সরকারি হাসপাতাল থেকে ঢাকায় পাঠানো হল। অপারেশন করতে হবে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তাসবীহর দানা গুণছেন। যিকির করছেন আর দু’চোখ পাকিয়ে চারদিক দেখছেন। কত রকমের রুগি! সাথে আসা সেবকদেরও নানা ধরন। একটু পর ডাক্তার আসবেন রাউন্ডে। নার্সরা দৌড়াদৌড়ি করে সব ঠিকঠাক করে রাখছেন। সদলবলে ডাক্তার এলেন। একপাশ থেকে দেখে দেখে আসছেন। বুড়ো ডাক্তারের সাথে একদল ছাত্র-ছাত্রীও আছে। ইন্টার্নী করছে তারা। আজ সাথে একজন মহিলা ডাক্তারও আছেন। দূর থেকে চেনা চেনা লাগল। বেগানা মহিলা। আবার তাকাবেন? তাকাব না তাকাব না করেও তাকিয়ে ফেললেন। ‘নাজমার’ মতো লাগছে না? শিয়রে বসে থাকা ছোটভাইকে খটকার কথা জানালেন। ভাই দেখার সাথে সাথেই চিনতে পারল, হাঁ নাজমা আপাই তো। তিনি ডাক্তারি পড়ছেন জানতাম, এই মেডিকেলেই থাকেন, সেটা জানা ছিল না। বিয়ের আগে ঢাকার বাইরে চাকুরি করতেন।
.
ভাইয়ের উপর চোখ পড়তেই ডা. নাজমার দু’চোখ ছানাবড়া। আরে ভাইয়া যে, বলেই একপ্রকার দৌড়ে এল। সাথে থাকা ডাক্তার-ইন্টার্ন-নার্সরাও অবাক হয়ে তাকাল। ডা. নাজমা কোনও রাগ-অভিমান ছাড়াই বললেন,
-দেখলেন, পালিয়ে থাকতে পেরেছেন? শেষতক দেখা হয়েই গেল, কী বলেন? আরে বাপু বিয়ে হয়নি তো কী হয়েছে? এতে লজ্জা পাওয়ার কী আছে। আমি বুঝেছি, আপনি অপারগ ছিলেন।
.
প্রাথমিক উচ্ছ্বাস থিতিয়ে এলে, নাজমা বুঝতে পারলেন, এখানে বেফাঁস আবেগ দেখিয়ে ফেলেছেন। ভাই কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কাঁচুমাচু হয়ে মাথা হেঁট করে বসে থাকলেন। যাক ঘটনা অনেকদূর পর্যন্ত গড়াল। বিকেলে খালা এলেন। সাথে এলেন খালু। পরদিন ডা. নাজমা এলেন স্বামীসহ। মানুষটা ভাল। রসিকতা করে বললেন,
-ভাই আপনার প্রতি আমি সত্যি সত্যি কৃতজ্ঞ। আপনি যদি ‘ওকে’ বিয়ে করে ফেলতেন। আমি এত ভাল একটা ‘জীবনসঙ্গী’ থেকে বঞ্চিত হতাম।
.
অপারেশন শেষ। ভাই বাড়ি ফিরবেন। খালার পরিবারের সবাই এতদিন হাসপাতালেই আদর-যতেœর চূড়ান্ত করলেন। একপ্রকার ধরেবেঁধেই বাসায় নিয়ে গেলেন। খালাত বোন আবদার জুড়েছে, আপনি তো আমাকে পছন্দ করলেন না, আপনার একটা মেয়ে আমাকে দেবেন? ভাই বললেন,
‘শর্ত আছে’!
‘কী শর্ত’?
তোর ছেলেটাকে মাদরাসায় পড়াতে হবে।
আচ্ছা ঠিক আছে। আমি রাজি। তবে ছেলের বাবা রাজি হবে কি না বুঝতে পারছি না। চেষ্টা করে দেখতে পারি।
.
খালাত বোন ছেলেকে সত্যি সত্যি ভাইয়ের কাছে পাঠিয়েছেন। শতভাগ শহুরে একটি ছেলে, হাজারভাগ বিশুদ্ধ গ্রামে পড়তে এসেছে। কষ্ট হলেও সহ্য করে থাকবে। খালাত বোন ভাইয়ের কাছে দিনের মধ্যে কয়েকবার ফোন করে। একদিন ভাই বললেন,
-এ্যাই, তুই এতবার কেন ফোন করিস? তোর কোনও দরকার থাকলে, তোর ভাবীর কাছে ফোন করবি। প্রয়োজন ছাড়া আমার কাছে ফোন করাটা গুনাহ।
-গুনাহ হবে কেন? আমি আমার ছেলের খোঁজ নেয়ার জন্য ফোন করি।
-এত খোঁজ নেয়ার কী আছে? বেশি ফোন করলে, আমাদের দু’জনের কাঁধেই শয়তান সওয়ার হওয়ার আশংকা।
-এই বুড়ো বয়েসে শয়তান সওয়ার হয়ে কী করবে?
-শয়তান বুড়োদের উপরই বেশি সওয়ার হয়। এবং তাদেরকে ঈমান-আমলহারা করে দেয়।
-আমার স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। এসব আপনার মনের কল্পনা।
-এভাবে কল্পনা থেকেই বাস্তব তৈরি হয়।
ভাই এরপর থেকে খালাত বোনের ফোন এলে ধরতেন না। বাড়িতে থাকলে ধরে, ভাবীকে দিয়ে দিতেন ফোনটা।
.
আমরা বসে বসে, সেদিন বিকেলে ‘মিনিটমাদরাসায়’ কী আলোচনা করা যায়, সেটা নিয়ে মুযাকারা (আলোচনা) করছিলাম। ভাই আলোচ্যবিষয়য়ের শিরোনাম বলে যাচ্ছেন, আমি খাতায় টুকে রাখছি। বড়ভাইয়ের কাছে এক তরুণ হুজুর এলেন। বেশভূষায় মনে হল, বিদেশ থাকেন। ভাই তাকে নিয়ে মসজিদে চলে গেলেন। একান্তে কথা বলার জন্য। দু’জনে অনেকক্ষণ কথা বললেন। আগত হুজুরকে দেখলাম কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। বড়ভাইয়ের চোখও অশ্রুসজল। কৌতুহল নিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম। মেহমান পুরো একবেলা থাকলেন। সারাক্ষণ ভাইয়ের সাথে একেবারে বলতে গেলে জোঁকের মতো লেগে থাকলেন। অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম, কে এই মাওলানা? ভাইয়ের ছাত্র হবে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। দেশেও থাকেন না, এটা প্রায় নিশ্চিত।
.
মেহমান পরে আবার আসবেন বলে বিদায় নিলেন। ভাইকে গুম হয়ে বসে রইলেন। আজ বিকেলের মিনিটমাদরাসার অসমাপ্ত মুযাকারার প্রসঙ্গ তুললাম। ভাই বললেন,
-কে এসেছিল জানেন? আমার খুবই আদরের ছাত্র ছিল একসময়। একসময় কেন, এখনো আদরেরই আছে। অনেকদিন দেখাসাক্ষাত যোগাযোগ ছিল না। দীর্ঘদিন পর দেখা করতে এসেছে। লন্ডনে থাকে।
-দু’জনকে কাঁদতে দেখলাম? কোনও সমস্যা?
-সমস্যা মানে বিরাট বিরাট। সমস্যাটা শুধু তার নয়, সমস্যা আমার, সমস্যা আপনার ভাবীর। সব সমস্যার মূলে ‘নাবীলা’!
এই নাম তো ভাইয়ের মুখে আগে কখনো শুনিনি। কে এই নাবীলা?
-আপনার কোনও আত্মীয়?
-তাকে আত্মীয় বানানোর জন্য কত চেষ্টা করলাম। না, মেয়ে আত্মীয় হবে না। এ-নিয়ে আমি আর আপনার ভাবী কী যে কষ্টে আছি। বাপ-মা মরা একটা মেয়ে। তায় আবার পঙ্গু। কীভাবে একা একা জীবন কাটাবে?
.
ভাইয়ের কাছে যা শুনলাম, গল্প-উপন্যাসকেও হারা মানাবে। আহ, নাবীলা মেয়েটার জন্য ব্যথায় বুকটা টনটন করে উঠল!
.
.
.
দাওয়াত রইল, নাবীলা নামের এক অসহায় শারীরিক প্রতিবন্ধী মহীয়সী নারীসহ, আরও কয়েকজন মহান-মহীয়সী মানব-মানবীর গল্পপাঠের। ইন শা আল্লাহ। দু‘আর দরখাস্ত।
THE END
(part 5)
ভাইয়ের জীবনটা যেন কুরআন ও সুন্নাহর জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। সারাবিশে^ হাজারো কওমী মাদরাসা। মিশকাত শরীফ কত মুহাদ্দিসই তো পড়ান। ভাইয়ের মতো এভাবে মেশকাতের প্রতিটি হাদীসকে জীবনের অন্দর পর্যায়ে আমলে নিয়ে আসনে কজন? জালালাইন পড়ান,এমন মুফাসসিরেরও অভাব নেই। কিন্তু সারাক্ষণ, হাটতে-চলতেও জালালাইনকে ধারণ করেন ক’জন?
.
তার পীর সাহেব তাকে ‘ইজাযত’ দিয়েছেন। বয়াত করানো শুরু করতে বলেছেন। ‘আমি কী বায়য়াত করাবো’ আমার হযরত এখনো জীবিত। আমার ভেতরটা এখনো নানা ‘গান্দা’ দ্বারা কলুষিত। পীর সাহেব হবেন, স্বচ্চ আয়নার মতো। মুরীদ তার কাছে এসে, নিজের দুর্বল দিকগুলো শায়খের আয়নার দেখবে। নিজেকে শোধরাবে। পীরের মধ্যেই যদি ‘নাপাকি’ থাকে, মুরীদ পাক হবে কীভাবে? পীর বেদাতি হলে, মুরিদও বেদাতি হবে। পীর ভিক্ষুক হলে, মুরীদও ভিক্ষুক হবে। পীর অশুদ্ধ হলে, মুরীদ কীভাবে বিশুদ্ধ হবে? আসল কথা হল, নিজের পাশাপাশি মানুষের হেদায়াতের ফিকির করা। সেটা আমি টুটাফাটা চেষ্টা করে যাচ্ছি। তার জন্য পীর সেজে বয়াত করার প্রয়োজন নেই। হেদায়াতের মালিক আল্লাহ। আমার শায়খের ইন্তেকালের পরও যদি আল্লাহ তা‘আলা হায়াতে রাখেন, তখন দেখা যাবে।
.
বয়েস বাড়তে বাড়তে, একেকজনের চিন্তায় একেকদিন প্রাধান্য পেয়ে যায়। বড় ভাইয়ের মধ্যে আল্লাহর ভালোবাসা আর কুরআনের চিন্তা প্রাধান্য পেয়েছে। যে কোনও আয়াত শোনার সাথে সাথে, বলে দিতে পারেন, এটা কোন ঘরানার। এখানে আল্লাহ কী বলেছেন, আমাদের জন্য কী শিক্ষণীয় বিষয় আছে। সবকিছুতে তিনি আল্লাহর কুদরত বের করে ফেলতে পারেন। এক দুর্লভ গুণ। যে মানুষ বলতে পারে, আল্লাহর জন্য তার সবসময় ‘পরান হোড়ে’ মানে প্রাণ কাঁদে, সে মানুষের চিন্তাজুড়ে আল্লাই থাকবেন, এ আর বিচিত্র কি!
.
ভাইয়ের কথা শুনে মনে মনে বলি, দরকার নেই আপনার পীর হয়ে। এমনিতে আপনি একার হাতে যা করছেন, প্রথাগত দশটা পীরের পক্ষেও তা সম্ভব হত কি না, ঘোরতর সন্দেহ আছে। আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে দিয়ে কাজ নিচ্ছেন। কত মানুষ আপনার কাছে দ্বীন শেখার সুযোগ পাচ্ছে। এ কম কথা!
.
ফাঁক পেলেই ভাবীর সাথে গুটুর গুটুর কথা বলতে শুরু করেন। প্রতিবার কথা শেষ করে মোবাইল আবিষ্কারকারীর জন্য হেদায়াতের দোয়া করতে ভোলেন না। দু’জনের এমন রসঘন প্রেমময় সম্পর্ক দেখে, একদিন জানতে চাইলাম,
- আপনাদের কখনো ঝগড়া বা মনোমালিন্য হয়নি?
-‘হয়েছে। ঝগড়া মনোমালিন্য ছাড়া সংসার হয় নাকি। কিন্তু রেহানার একটা অসাধারণ গুণ হল, সে যতকিছুই হোক, সাথে সাথে গিলে হজম করে ফেলতে পারে।
আরেকটা ব্যাপার, আমি সবসময় বিপদজনক পরিস্থিতিতে থাকি। আমার ছাত্রীরা বড় হয়েছে। ছাত্রের বউরা আছে। তারা নানা প্রয়োজনে আমার কাছে আসে। আমারও নানা কাজে তাদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয়। শয়তান চারপাশে ঘোরাঘুরি করে। আমি টের পাই। ইবলীস শুধুই সুযোগ খোঁজে। কীভাবে আমাকে ফাঁদে ফেলতে পারে। এমন জীবন্ত ফিতনার মাঝে গুনাহমুক্ত থাকতে হলে, আমার শক্তিশালী একটা আশ্রয়কেন্দ্র (এন্টিভাইরাস) দরকার। বিবিকে আল্লাহর আমার জন্য জান্নাত বানিয়ে পাঠিয়েছেন। জান্নাত যেমন পূত-পবিত্র, বৃষ্টির পানি যেমন নিষ্কলুষ, আমার বিবিও তেমন। আল্লাহর ঘোষণা দেয়া হালাল। পবিত্র। বিবির সাথে মনোমালিন্য খুব কমই হয়, হলেও সাথে সাথে হজম করে ফেলি। এই ফিতনার যমানায়, বিবি আমার জন্য শক্তিশালী এক দুর্গ।
.
মাঝেমধ্যে ঢাকায় আসতে হয়। ঢাকায় কত আত্মীয়-স্বজন থাকেন, কারও বাসায় যেতে ভাইয়ের মন সায় দেয় না। তার কাছে মাদরাসার পরিবেশই ভাল লাগে। পরিচিত কোনও মাদরাসাতেই রাতটুকু কাটিয়ে দেন। আপন খালা থাকেন ঢাকায়, সেই যে বিয়ে ভেঙে গেছে, তারপর থেকে লজ্জায় হোক বা অন্য কোনও কারণে হোক, খালার বাসায় যেতে সংকোচ বোধ হয়। তিনি জানতেন, তার সাথে বিয়ে না হওয়াতে খালা ও খালাত বোন উভয়েই ভীষণ মর্মাহত হয়েছে।
.
ভাই একবার মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। নিজের জেলাশহরের সরকারি হাসপাতাল থেকে ঢাকায় পাঠানো হল। অপারেশন করতে হবে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তাসবীহর দানা গুণছেন। যিকির করছেন আর দু’চোখ পাকিয়ে চারদিক দেখছেন। কত রকমের রুগি! সাথে আসা সেবকদেরও নানা ধরন। একটু পর ডাক্তার আসবেন রাউন্ডে। নার্সরা দৌড়াদৌড়ি করে সব ঠিকঠাক করে রাখছেন। সদলবলে ডাক্তার এলেন। একপাশ থেকে দেখে দেখে আসছেন। বুড়ো ডাক্তারের সাথে একদল ছাত্র-ছাত্রীও আছে। ইন্টার্নী করছে তারা। আজ সাথে একজন মহিলা ডাক্তারও আছেন। দূর থেকে চেনা চেনা লাগল। বেগানা মহিলা। আবার তাকাবেন? তাকাব না তাকাব না করেও তাকিয়ে ফেললেন। ‘নাজমার’ মতো লাগছে না? শিয়রে বসে থাকা ছোটভাইকে খটকার কথা জানালেন। ভাই দেখার সাথে সাথেই চিনতে পারল, হাঁ নাজমা আপাই তো। তিনি ডাক্তারি পড়ছেন জানতাম, এই মেডিকেলেই থাকেন, সেটা জানা ছিল না। বিয়ের আগে ঢাকার বাইরে চাকুরি করতেন।
.
ভাইয়ের উপর চোখ পড়তেই ডা. নাজমার দু’চোখ ছানাবড়া। আরে ভাইয়া যে, বলেই একপ্রকার দৌড়ে এল। সাথে থাকা ডাক্তার-ইন্টার্ন-নার্সরাও অবাক হয়ে তাকাল। ডা. নাজমা কোনও রাগ-অভিমান ছাড়াই বললেন,
-দেখলেন, পালিয়ে থাকতে পেরেছেন? শেষতক দেখা হয়েই গেল, কী বলেন? আরে বাপু বিয়ে হয়নি তো কী হয়েছে? এতে লজ্জা পাওয়ার কী আছে। আমি বুঝেছি, আপনি অপারগ ছিলেন।
.
প্রাথমিক উচ্ছ্বাস থিতিয়ে এলে, নাজমা বুঝতে পারলেন, এখানে বেফাঁস আবেগ দেখিয়ে ফেলেছেন। ভাই কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কাঁচুমাচু হয়ে মাথা হেঁট করে বসে থাকলেন। যাক ঘটনা অনেকদূর পর্যন্ত গড়াল। বিকেলে খালা এলেন। সাথে এলেন খালু। পরদিন ডা. নাজমা এলেন স্বামীসহ। মানুষটা ভাল। রসিকতা করে বললেন,
-ভাই আপনার প্রতি আমি সত্যি সত্যি কৃতজ্ঞ। আপনি যদি ‘ওকে’ বিয়ে করে ফেলতেন। আমি এত ভাল একটা ‘জীবনসঙ্গী’ থেকে বঞ্চিত হতাম।
.
অপারেশন শেষ। ভাই বাড়ি ফিরবেন। খালার পরিবারের সবাই এতদিন হাসপাতালেই আদর-যতেœর চূড়ান্ত করলেন। একপ্রকার ধরেবেঁধেই বাসায় নিয়ে গেলেন। খালাত বোন আবদার জুড়েছে, আপনি তো আমাকে পছন্দ করলেন না, আপনার একটা মেয়ে আমাকে দেবেন? ভাই বললেন,
‘শর্ত আছে’!
‘কী শর্ত’?
তোর ছেলেটাকে মাদরাসায় পড়াতে হবে।
আচ্ছা ঠিক আছে। আমি রাজি। তবে ছেলের বাবা রাজি হবে কি না বুঝতে পারছি না। চেষ্টা করে দেখতে পারি।
.
খালাত বোন ছেলেকে সত্যি সত্যি ভাইয়ের কাছে পাঠিয়েছেন। শতভাগ শহুরে একটি ছেলে, হাজারভাগ বিশুদ্ধ গ্রামে পড়তে এসেছে। কষ্ট হলেও সহ্য করে থাকবে। খালাত বোন ভাইয়ের কাছে দিনের মধ্যে কয়েকবার ফোন করে। একদিন ভাই বললেন,
-এ্যাই, তুই এতবার কেন ফোন করিস? তোর কোনও দরকার থাকলে, তোর ভাবীর কাছে ফোন করবি। প্রয়োজন ছাড়া আমার কাছে ফোন করাটা গুনাহ।
-গুনাহ হবে কেন? আমি আমার ছেলের খোঁজ নেয়ার জন্য ফোন করি।
-এত খোঁজ নেয়ার কী আছে? বেশি ফোন করলে, আমাদের দু’জনের কাঁধেই শয়তান সওয়ার হওয়ার আশংকা।
-এই বুড়ো বয়েসে শয়তান সওয়ার হয়ে কী করবে?
-শয়তান বুড়োদের উপরই বেশি সওয়ার হয়। এবং তাদেরকে ঈমান-আমলহারা করে দেয়।
-আমার স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। এসব আপনার মনের কল্পনা।
-এভাবে কল্পনা থেকেই বাস্তব তৈরি হয়।
ভাই এরপর থেকে খালাত বোনের ফোন এলে ধরতেন না। বাড়িতে থাকলে ধরে, ভাবীকে দিয়ে দিতেন ফোনটা।
.
আমরা বসে বসে, সেদিন বিকেলে ‘মিনিটমাদরাসায়’ কী আলোচনা করা যায়, সেটা নিয়ে মুযাকারা (আলোচনা) করছিলাম। ভাই আলোচ্যবিষয়য়ের শিরোনাম বলে যাচ্ছেন, আমি খাতায় টুকে রাখছি। বড়ভাইয়ের কাছে এক তরুণ হুজুর এলেন। বেশভূষায় মনে হল, বিদেশ থাকেন। ভাই তাকে নিয়ে মসজিদে চলে গেলেন। একান্তে কথা বলার জন্য। দু’জনে অনেকক্ষণ কথা বললেন। আগত হুজুরকে দেখলাম কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। বড়ভাইয়ের চোখও অশ্রুসজল। কৌতুহল নিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম। মেহমান পুরো একবেলা থাকলেন। সারাক্ষণ ভাইয়ের সাথে একেবারে বলতে গেলে জোঁকের মতো লেগে থাকলেন। অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম, কে এই মাওলানা? ভাইয়ের ছাত্র হবে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। দেশেও থাকেন না, এটা প্রায় নিশ্চিত।
.
মেহমান পরে আবার আসবেন বলে বিদায় নিলেন। ভাইকে গুম হয়ে বসে রইলেন। আজ বিকেলের মিনিটমাদরাসার অসমাপ্ত মুযাকারার প্রসঙ্গ তুললাম। ভাই বললেন,
-কে এসেছিল জানেন? আমার খুবই আদরের ছাত্র ছিল একসময়। একসময় কেন, এখনো আদরেরই আছে। অনেকদিন দেখাসাক্ষাত যোগাযোগ ছিল না। দীর্ঘদিন পর দেখা করতে এসেছে। লন্ডনে থাকে।
-দু’জনকে কাঁদতে দেখলাম? কোনও সমস্যা?
-সমস্যা মানে বিরাট বিরাট। সমস্যাটা শুধু তার নয়, সমস্যা আমার, সমস্যা আপনার ভাবীর। সব সমস্যার মূলে ‘নাবীলা’!
এই নাম তো ভাইয়ের মুখে আগে কখনো শুনিনি। কে এই নাবীলা?
-আপনার কোনও আত্মীয়?
-তাকে আত্মীয় বানানোর জন্য কত চেষ্টা করলাম। না, মেয়ে আত্মীয় হবে না। এ-নিয়ে আমি আর আপনার ভাবী কী যে কষ্টে আছি। বাপ-মা মরা একটা মেয়ে। তায় আবার পঙ্গু। কীভাবে একা একা জীবন কাটাবে?
.
ভাইয়ের কাছে যা শুনলাম, গল্প-উপন্যাসকেও হারা মানাবে। আহ, নাবীলা মেয়েটার জন্য ব্যথায় বুকটা টনটন করে উঠল!
.
.
.
দাওয়াত রইল, নাবীলা নামের এক অসহায় শারীরিক প্রতিবন্ধী মহীয়সী নারীসহ, আরও কয়েকজন মহান-মহীয়সী মানব-মানবীর গল্পপাঠের। ইন শা আল্লাহ। দু‘আর দরখাস্ত।
THE END
কোন মন্তব্য নেই