Header Ads

Header ADS

যে গল্পে ঽদয় গলে-You must read (part 1)




দোস্ত, জানেমান!
(উপন্যাসিকা)part 1




সেই সাতসকালে রওয়ানা দিলেও, গাড়ি থেকে নামতে নামতে রাত সাড়ে এগারটা বেজে গেল। নতুন জায়গা, কীভাবে এই অচিন গাঁয়ে যাবো? ফোন আছে, এটাই যা ভরসা। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা, ভুল করে এক স্টপেজ আগে নেমে পড়েছি। টমটমঅলারা কেউ আমার গন্তব্য চেনে না। সুযোগ বুঝে ভাড়াও হাঁকছে কল্পনাতীত চড়া দরে। সব চালকদের মধ্যে কীভাবে যেন ‘ঐক্যমত্য’ তৈরি হয়েছে। প্রতিটি স্টেশনেই বোধ হয় চালকদের মধ্যে অলিখিত-অকথিত অদৃশ্য এক বোঝাপড়া থাকে। নতুন কেউ এলে, ঠিক বুঝে যায়। তাদের মধ্যে চোখাচোখি হয়। গোপন ইথারে কথাবার্তা হয়। বোঝাপড়া হয়।
.
রাত গভীর হয়ে যাওয়াতে ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে। প্রথমজন ভাড়া যা বলেছে, সেটাই অমোঘ হয়ে গলায় বিঁধে আছে। এহেন পরিস্থিতিতে আগন্তুককে ভাব-অভিব্যক্তিত একধরনের কুছ পরোয়া নেহি, ড্যামকেয়ার ভাব আনতে হয়। ভাড়া না কমালে, হেঁটেই রওয়ানা হয়ে যাবো, এমন ভাবসাব। কৌশলটা কাজে লাগল না। চালকসমিতি বুঝে ফেলেছে। মাছ যতই খলবল করুক, ডাঙ্গায় তাকে উঠে আসতেই হবে। দরদামের ফাঁকে ফাঁকে, সমানে সূরা কুরাইশ পড়ে যাচ্ছি। রাত আরও গভীর হচ্ছে। কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক বয়স্ক চালকের মনে বোধ হয় দয়ার উদ্রেক হল। মনোপলি ভেঙে টমটম নিয়ে এগিয়ে এল। অচলাবস্থার অবসান। সহনীয় একটা ভাড়া বলল। ‘আপনার ইচ্ছা হলে, কিছু বাড়িয়ে দিয়েন’। আরেকজন পাশ বলল কথাটা। টিকা না টীপ্পনী বুঝে উঠতে পারলাম না। নাকি এটাও তাদের টমটমী মনোপলির মিটমিটে শয়তানী! সংসারে, বাইরে, সবতাতে আপোষের পথে হাঁটাই নিরাপদ। ঘাড় গোঁজ করে অনঢ় অবস্থান, সুখ বয়ে আনে না। আদর্শিক ব্যাপারে অবশ্যই মরিয়া অবস্থান নিতে হয়। দাম্পত্য আর জীবনযাপনে, ছাড়ের পথে পা বাড়াতে হয়। নইলে পদে পদে বাধা আর বাধা।
.
চুক্তি ভঙ্গ করলে, শাস্তি পেতে হয়। টমটমঅলা অলিখিত চুক্তি ভঙ্গ করে এগিয়ে এসেছে। সবাই কটমট করে তাকানোর কথা ছিল। তেমন কিছু হল না। যেন ঘটনা এমনই ঘটার ছিল। আন্দাজের উপর ভর করে আঁধারে পা বাড়িয়েছি। ভুল বললাম, চাকা ছুটিয়েছি বলতে হয়। কোথায় যাচ্ছি, চালকও জানে না, আমিও না। জানি শুধু বাড়ির নাম। জীবনও কি এমন নয়? জীবনের গন্তব্য কোথায় গিয়ে শেষ হবে, আমরা কি নিশ্চিত করে জানি? ভরসার কথা, চালক আবছা চিনতে পেরেছেন বোধ হয়। চাকা ঘুরছে। সাথে চলছে চালকের মুখ। গাড়িতে বা রিকশায় উঠলে, চালকের সাথে কথা বলার অভ্যেস থাকা ভাল। সময়ে সময়ে বেশ কাজে দেয়। অনেক তথ্য জানা যায়। অনেক চালক দেখা যায় আগে বিদেশে ছিলেন। অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ থাকে। মাঝেমধ্যে হুঁ হাঁ করতে হয়। সলতে উস্কে দেয়া আরকি। চালক আপন মনে কথা বলে যায়। বলতে পেরে সুখ পায়। যাত্রীরা সাধারণত তার চেয়ে উঁচু শ্রেনির হয়। তার কথা মান্যিযুগ্যি কেউ মনোযোগ দিয়ে শুনছে, এই ভাবনা, তার মধ্যে এক ধরনের তৃপ্তিবোধ ছড়িয়ে দেয়। অবাধ্য ছাত্রকে মনযোগী ছাত্র হিশেবে পাওয়ার মজা লুকিয়ে থাকে হয়তো।
.
চালক আজ আটাশ বছর ধরে এই অঞ্চলে রিকশা চালাচ্ছেন। আগে চালাতেন প্যাডেলের রিকশা। কালের ফেরে এখন টমটম। এতদাঞ্চলের নাড়ি-নক্ষত্র তার নখদর্পণে। বারবার বলতে লাগল, আপনার ভাগ্য ভালো। আমাকে পেয়ে গেছেন। অন্যরা এই অন্ধকারে কিছুই চিনত না। আমারও কী মনে হল, সবাইকে ঠেলে জোর করে আপনাকে নিয়ে এলাম। কাজটা ভাল হয়েছে। সবাই রাগ করবে, করুক। আপনার উপকার হয়েছে, এতেই শান্তি। মা শা আল্লাহ, আত্মপ্রচার বেশ ভালোই। পণ্যের গুণগান না গাইলে ভোক্তা অকৃষ্ট হবে কেন? কর্পোরেট দুনিয়ায় জাঁ-চকচকে ঢেঁকিগেলানো বিজ্ঞাপন থাকলে, অজগাঁয়ে থাকতে বাধা কোথায়?
.
চালকের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে অফুরন্ত গল্প। এখন যেমন সিএনজি ভাড়া করা হয়, আগের দিনে রিকশা ভাড়া করা হত। বাপের বাড়িতে নাইওর যাবে। বাপের বাড়ি থেকে জামাইর বাড়ি আসবে। একসপ্তাহ আগে বলে রাখতে হত। একসময় এই তল্লাটে রিকশা বলতে, শুধু তারটাই ছিল। দূরত্বও যা তা ছিল না। দূর-দূরান্তের গন্তব্যে যেতে হত। কোথাও গেলে, রাতে সে বাড়িতে থেকে আসতে হত। খানাপিনা হত দুলহার মতো। মেয়েরা বাপের দেশের কুকুর-বেড়ালকেও বড় আপন ভাবে। আমি তো মানুষ। সবসময় আমার রিকশাতে চড়েই আসা-যাওয়া হয়। বাবা-মা, ভাইবোনকে ছেড়ে এসেছে। মন ভীষণ খারাপ। আমিই বাবা-মায়ের যোগসূত্র। আমাকে আপ্যায়ন করে, বাবার বাড়ির স্মৃতি জাগিয়ে রাখার প্রয়াস চালাচ্ছে।
.
মাঝেমধ্যে যাত্রী ছাড়াই এখানে ওখানে যেতে হত। নানী তার নাতির জন্য পিঠা-পুলি পাঠাবেন। আমার ডাক পড়ত। কারও বাড়িতে জেয়াফত হবে। আমার হাতে ফর্দ ধরিয়ে দেয়া হত। আমি দূরের শম্ভুগঞ্জে ননাবাবুর দোকান থেকে সব মিলিয়ে সদাই করে আনতাম। এমন হাজারো কাজ। ঢাকা থেকে কেউ আসবে অমুক দিন। সন্ধ্যা থেকে লঞ্চঘাটায় গিয়ে বসে আছি। শেষ রাতে লঞ্চ ঘাটে ভিড়বে। নিরিবিলি দেখে রিকশা থামিয়ে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়তাম। লঞ্চের ভেুঁপর কানফাটানো আওয়াজে ধড়মড় করে উঠতাম। ঢাকাফেরতা সাহেব জানেন, আমাকে কোথায় পাওয়া যাবে।
.
টমটম চালকের গল্পবলার নেশা আছে। বলার ভঙ্গিও ভাল। রাতদুপুরে একনাগাড়ে বকবক করতে করতে যাচ্ছে। মোটেও অস্বাভাবিক লাগছে না। মনে হচ্ছে এমনটাই হওয়ার কথা। বড়ভাই একটু পরপর ফোন করে জেনে নিচ্ছেন। তিনিও বুঝতে পারছেন না, আমরা এখন কোথায় আছি। মোবাইলটা চালককে ধরিয়ে দিলাম। আকাশে চাঁদ নেই। মেঘ আছে। রাস্তাঘাট পাকা। পিচঢালা। কাঁচা হলে প্যাঁচপ্যাঁচে কাঁদাময় হয়ে থাকত। পথচলা সহজ হত না। গাড়ি তরতর করে এগুচ্ছে। চলার গতি মসৃণ হচ্ছে না। একটু পরপর থামছে গাড়ি। চালকই থামাচ্ছে। বোধ হয় শ্রোতার মুখের দিকে না তাকিয়ে কথা বলে আরামবোধ করেন না। তাই আবেগ এসে গেলে, গাড়ি থামিয়ে দুই হাত নেড়ে বক্তব্য দিচ্ছে। বেশ ভালো চালকের পাল্লাতেই পড়া গেল। এমন গা-ছমছমে ভুতুরে অন্ধকারেও কেউ, অচেনা কারও সাথে, জমিয়ে গল্প করতে পারে, জানা ছিল না তো। গন্তব্যে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় দশবারের মতো গাড়ি থামিয়েছেন। বেশ উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা চালিয়ে গেছেন। যতই বলি সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালান, কে শোনে কার কথা। সব রাস্তা নাকি হাতের রেখার মতো চেনা। দু’বার পুকুরে পড়তে পড়তে শেষ মুহূর্তে কাটাতে পারল। আটাশ বছরের অভিজ্ঞ চালক, পুকুরজল থেকে বেঁচে গিয়েও নির্বিকার। যেন কিছুই হয়নি। আবার রিকশা সোজা করে, বিরতিহীন মুখ চালু করে দিয়েছেন। সামনে-পেছনে-ডানে-বামে-উপরে-নিচে সবদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রিকশা থামলেই মনে হয় পেছন থেকে কিছু একটা এসে এই বুঝি টুটি চেপে ধরল। শুকনো পাতার খসখস আওয়জ হলেই পেছনের চুলগুলো সরসর করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কিছু বলাও যাচ্ছে না। পাছে ভীতু মনে করে ভুত হয়ে চাপে!
.
গতকয়েকদিন ভীষণ উনতালা (ভ্যাপসা গরম) গেছে। গাছের পাতাগুলো নড়তে পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিল। আজ আরামদায়ক হালকা শীতল বাতাস বইছে। দু’পাশে ঘরবাড়ি সুনসান। একটা শিশু কেঁদে উঠল। মা আবার ঘুমপাড়াতে চেষ্টা করছে। বুড়োর খকখক কাশি আর টমটমের হরণ একাকার হয়ে গেল। মনে হল, আমার এই পথযাত্রা কখনোই শেষ হবে না। পথ চলতে চলতে প্রায়ই এমন মনে হয়। থিকথিকে ভীড়াক্কার বাসে বসেও হঠাৎ মনে হয় আমি এখানে নেই। নির্জন কোনও বন বনানীর বন্যায় ভেসে বেড়াচ্ছি। দূর থেকে মোবাইলের আলো দেখা গেল। একটু পর মসজিদ। একজন দাঁড়িয়ে আছেন। সালাম শুনে স্বস্তি ফিরে এল। নীড়ে ফিরলাম তাহলে।
.
রাতের খাবার না খেয়ে এতক্ষণ অপেক্ষা মেহমানের প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছিলেন। বলা ভাল, তাসবীহের দানা টিপছিলেন। খেতে খেতে বেশ গল্প হল। গল্প বলতে, কুরআন নিয়ে আলোচনা। ভাইয়ের এই এক চমৎকার স্বভাব। আলিম সঙ্গী পেলে, কুরআন কারীমের জটিল কোনও বিষয় নিয়ে কথা পাড়েন। সাধারণ মানুষের সাথে মাসয়ালা বা দ্বীনদারি নিয়ে আলাপ জুড়েন। আগামীকাল দরসে যেতে হবে। কথা না বাড়িয়ে মালশি (পাতলা কাঁথা) মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। তাহাজ্জুদের জন্য উঠতে হবে। ভারি মজা তো! শুতে না শুতেই গভীর সুপ্তি। গররর নাক ডাকছে। অনেকে গররর আওয়াজে ঘুমুতে পারে না। আমি পারি। অন্যের যা ঘুমহারক আমার তা ঘুমসহায়ক। ঘুমের আলাদা ঘ্রাণ আছে। আঁশটে গন্ধ। নাক ডাকার আওয়াজ বেয়ে সে সুঘ্রাণ আমার কানে এসে পশে। তলিয়ে যেতে থাকি গাঢ় নীঁদে।
.
এখানে এসেছি এক বড়ভাইয়ের কাছে। ধরা যাক তার নাম ‘আবদুল্লাহ’। বড়ভাই বলতে যেমন চিত্র ফুটে ওঠে, ঠিক সেরকম নয়। আবদুল্লাহ ভাইয়ের চুলদাড়িতে পাক ধরেছে। অত্যন্ত যোগ্য আলিম। সুদূর পাড়াগাঁয়ে মাটি কামড়ে পড়ে আছেন। সবাই শহরমুখী হলে, গ্রামের গরীব মাদরাসাগুলোর কী হবে? আমরা যাদের উত্তরসূরী, তারা তো ছাত্রজীবন শেষ করে, শহরমুখী হতেন না। তারা লেখাপড়া শেষ করে, নিজের গ্রামে বা পশ্চাদপদ কোনও গাঁয়ে গিয়ে বসে যেতেন। বাকী জীবন ওখানেই কেটে যেত। কালক্রমে তাকে ঘিরে গড়ে উঠত একটি ঘরানা। একটি খানকা। একটি মাদরাসা। একটি আন্দোলন। বেরিয়ে আসত একদল যোগ্য আলিম, দাঈ, মুজাহিদ, গাজী।
.
ঊনত্রিশটি বছর কেটে গেছে। এই গ্রামে। এই মসজিদে। অবাক করা ব্যাপার, আজো বেতন সেই সাড়ে পাঁচ হাজার। চাওয়া নেই। দাবি-দাওয়া নেই। মাস শেষে কিছু দিলেও খুশি। না দিলেও ওজর-আপত্তি নেই। টাকা নেই, দু’বেলা চারটা ভাত জুটে যাচ্ছে তো! আর বেশি কী চাই? চারটা খাবার জুটলে, মাথা গোঁজার একটি ঠাঁই থাকলে, পরনে যা হোক, মানানসই একটা আবরণী থাকলে, জীবনে আর কিছু লাগে কি?
.
জায়গীর বাড়ি থেকে মাদরাসা বহুদূরের হাঁটাপথ। আসা-যাওয়ায় কষ্ট হয়। সময়ও লাগে অনেক। একটা সাইকেল হলে বেশ হত। তিনহাজার টাকা কোথায় পাবেন? কিছু ধারদেনা, কিছু বকেয়াতে সাইকেল একটা কিনেছিলেন। আঠার বছর বছর পর তিন হাজার টাকাতেই সেই সাইকেল বিক্রি করেছেন। মামা জাপান থেকে পোনিক্স সাইকেল এনে বিক্রি করতেন। তার কাছ থেকে কেনা। মা ধান বিক্রি করে করে ভাইয়ের বকেয়া শোধ করেছিলেন।
.
দু’দিন পরের কথা। বড়ভাইয়ের সাথে দূর গ্রামে গিয়েছি। এক ছাত্রীর ছেলে হয়েছে। জামাইকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে। হুজুর গিয়ে আজান-একামত দিয়ে তাহনীক করিয়ে আসতে হবে। এমন অজপাড়াগাঁর মেয়েও ‘তাহনীক’ বোঝে। ওস্তাদের শিক্ষা। যথাসময়ে হুজুর হাজির। সবকাজ শেষ। আমরা চলে আসব। আজব ব্যাপার! পর্দার ওপাড়ে কান্নার আওয়াজ উঠল। স্বামী বেচারা পড়ল বিপাকে। কাঁচুমাচু হয়ে বলল,
-হুজুর একটা দিন থাকা যায় না। ‘ও’ বারবার বলছে, অন্তত আজকের রাতটুকু থেকে যেতে।
হুজুর কিছুতেই রাজি নন। মাদরাসার সবক পড়াতে হবে। এখানে থাকলে পরদিন সময়মত দরসে হাজির হতে পারবেন না। আগামীকালের সবক মুতালা‘আ না করে, দরসে বসা ঠিক হবে না। আগে বললে, থাকার প্রস্তুতি নিয়ে আসতাম। আর থাকতে না পেরে, সদ্যসন্তান প্রসব করা ‘মা’ বলে উঠল,
-হুজুর, আপনিই আমার বাবা-মা। তার কেউ বেঁচে নেই। ভাইবোন নেই। এখন আপনিও যদি আমাকে না দেখেন, আমার আর রইল কে? এখানে আপনিই দেখেশুনে সম্বন্ধ করেছেন। মেয়ের বাড়িতে ‘বাবা’ একটা দিন থাকলে, কী এমন ক্ষতি হয়ে যাবে শুনি?
.
বড়ভাই পড়লেন ভীষণ মুশকিলে। নরম দিলের মানুষ। অল্পতেই মুষড়ে পড়েন। ‘মেয়ের’ দরদী কান্না দেখে তার গলাটাও ভিজে এল। একদিকে কর্তব্য আরেকদিকে আত্মার টান। শেষপর্যন্ত কর্তব্য জয়ী হল। বুঝিয়ে-শুনিয়ে অপারগতার কথা জানালেন। আরেকদিন আসার ওয়াদা করে ছাড় পেলেন। চোখ মুছতে মুছতে ফিরতি পথ ধরলেন। দু’জন চুপচাপ হাঁটছি। স্বামী আমাদের সাথে সাথে কিছুদূর আসলেন। বড়ভাই জোর করে ফেরত পাঠালেন। পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারছিলাম, বাড়ির কোনে তালগাছটির আড়ালে, সদ্য মা হওয়া মেয়েটি একবুক হাহাকার নিয়ে আমাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টির আড়াল হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। বড়ভাইই বললেন সেটা।
.
বামনহাটা আসতে আসতে মাগরিবের আজান হয়ে গেল। নামাজ পড়ে বড়ভাই কিছুক্ষণ যিকির করেন। ওজীফা আদায় করেন। তার শায়খের সবক হল, আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত ইসমে যাতের যিকির। পঞ্চাশ হাজার বার। আজ প্রসূতি মায়ের আবদার রক্ষা করতে গিয়ে সবক ছুটে গেছে। এখন কাযা আদায় করতে হবে।
.
গ্রামের পথ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। হাতে টর্চ আছে। থাকাই সার। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ওটার মিনমিনে আলো নিকষ কালো আঁধারকে আরও জমাটি করে তুলছে। আমি বারবার হোঁচট খেলেও বড়ভাই দিব্যি হাঁটছেন। বড়ভাই ক্ষুধা সহ্য করতে পারেন না। তার ক্ষুধা লেগে গেছে। এখন উপায়? অনেকক্ষণ হাঁটার পর একটা গ্রাম এল। শানবাঁধানো ঘাটলায় পা ধুয়ে কিছুক্ষণ বসলেন। একটু পর কিছু না বলে ঘরের দিকে হাঁটা দিলেন। আমি অবাক। ভাই যাচ্ছেন কোথায়? ক্ষুধায় দিকজ্ঞানশুন্য হয়ে পড়ল না তো? দেখা যাক। একটা পাকাবাড়ির দরজার সামনে গিয়ে, সালমা বলে হাঁক দিলেন। এদিকটাতে এখনো বিদ্যুত আসেনি। তবে অবস্থাপন্ন বাড়িতে সৌরবিদ্যুত আছে বোধ হয়। ভেতরে আলো জ¦লছে। মোবাইলে কিছু একটা বাজছে। ছাড়া ছাড়া আওয়াজ আসছে। খুট করে দরজা খোলার আওয়াজ হল। হারিকেন হাতে এক পুরুষ বের হয়ে এল। বড়ভাইকে দেখে আকাশ থেকে পড়ল, রীতিমতো গলা ফাটিয়ে বলল,
- হুজুর আপনি? সালমার মা, দেখো কে এসেছে। দেখো কে এসেছে!
ভাই এগিয়ে পুরুষটাকে জড়িয়ে ধরলেন। না দোস্ত, বেশিক্ষণ থাকব না। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম তোমাদের একবার দেখে যাই। আর ক্ষুধাও লেগেছে। চারটা ডালভাত যা আছে, খেয়েও যাবো। বাড়ির পুরুষটা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে! কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। ছোট্ট একটি মেয়ে দৌড়ে এসে ভাইয়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আরেক ছাত্রীর বাড়ি। ডালভাত বললেই কি গেরস্থ মানে? একটু পর কঅঅক কঅঅঅক আওয়াজে ভাই চকিত বিস্ময়ে বললেন, এজন্যই তোদের কাছে আসতে ইচ্ছে করে না। যা আছে, তা দিয়ে মেহমানদারি করবি, তা না, রাতের আঁধারে শেয়ালের মতো খোয়াড়ে হানা দিয়েছিস। অবলা মোরগগুলো বিশ্রাম করছে। তাদেরকে কষ্ট দেয়া কেন?
.
একদিন বাজারে গিয়েছি। দু’জনের হাতে ঢাউস চারটি ব্যাগ। ছাত্ররা বিদেশ থাকে। বাড়িতে তাদের বুড়িমা আর বউবাচ্চা। তাদের বাজার খরচের টাকা ভাইয়ের হাতে থাকে। কিছু লাগলে, এসে বলে। ভাই আসর নামায পড়ে বাজার করে মসজিদের সামনে রাখেন। ছেলে-মেয়েরা এসে যে যার বাজার নিয়ে যায়। পাই-পয়সার হিশেব পর্যন্ত খাতায় টুকে রাখেন।
.
আসরের পর পিলপিল করে কচি-কাঁচারা এসে হাজির। কারও হাতে ছোট্ট বোতল। কারও হাতে পানির গ্লাস। কারও হাতে জগ। পানিপড়া নিতে এসেছে। সবাই পানিপড়া নেয়া শেষ। ছোট্ট এক খুকি তার ক্ষুদ্রতর পিচ্চি ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে এককোনে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বড়ভাইয়ের চোখ পড়ল,
-কী রে বালি, বোতল কই?
বোতল নেই। লজ্জায় চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুঁটছে। বড়ভাই বুঝে গেছেন,
-কাছে আয়! টাকা হাওলাত লাগবে বুঝি?
খুকিটা আরও আধোবদন। মিউমিউ স্বরে বলল,
-আম্মা বলেছেন কয়টা টাকা হাওলাত দিতে!
বড়ভাইয়ের স্বরটা সাথে সাথে কান্নাভেজা হয়ে গেল। ফুঁপিয়ে উঠে দ্রুতপদে খাটের কাছে গেলেন। চৌকির নিচ থেকে আদ্যিকালের ঢাউস ট্রাংক রীতিমতো ধস্তাধস্তি করে বের করলেন। আঁতিপাতি করে খুঁজে বের করলেন দু’শো টাকার দু’টি নোট। খুঁকির হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন,
-শরম কিসের রে বেটি! তোর মাকে বলবি, যখনই হাতখরচের টাকা ফুরিয়ে যাবে, আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে।
.
খুকি চলে চাওয়ার পর বললেন,
-শিউলি। আমার ছাত্রী। এখন বাপের বাড়িতে থাকে। স্বামী ঢাকা থাকে। গরীব। কামকাজ করলেও খরচ চালাতে পারে না। শাশুড়ির জ¦ালায় থাকতে না পেরে, বাপের বাড়িতে চলে এসেছে।
.
প্রথম প্রথম এমন হত, যে-ই টাকার জন্য আসত, বড়ভাই পকেট হাতড়ে দিয়ে দিতেন। মাসশেষে দেখা যেত, বাড়ির খরচের টাকা তো বটেই, নিজে মাদরাসায় যাওয়ার ভাড়াও নেই। ওদিকে বাড়িতে ভাতের চাল নেই। ছেলেদের মাদরাসায় যাওয়ার খরচ নেই। সুবিধাবাদী লোকেরা সুযোগ বুঝে নানা ছুতোয় টাকা চাইতে আসত। বড়ভাই পকেটে টাকা থাকলে, না করতে পারতেন না। এদিকে নিজের ছেলেমেয়ে যে না খেয়ে নিরম্বু উপোস দিচ্ছে, সেকথা খেয়াল থাকত না। ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর, মসজিদের লোকজন বুদ্ধি করে বেতনের তিনভাগের দুই ভাগ সরাসরি ভাবীর কাছে পাঠাতে শুরু করে। বাকিটাকা ভাইয়ের হাতে। বেতনের পরিমাণও যৎকিঞ্চিত। আজ ঊনত্রিশ বছর পর সাড়ে পাঁচ হাজার।
.
ইমাম সাহেব ছোট্ট খুকিদের সাথে কুতকুত খেলছেন, ব্যাপারটা নিজচোখে না দেখলে, কারও বিশ্বাস হবে না। মুসল্লিদের কাছে অবিশ্যি ব্যাপারটা চোখসহা হয়ে গেছে। একদিন শুয়ে আছি। বড়ভাই তার বিখ্যাত নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছেন। দরজা হাট করে খোলা। একটু পর এক খুকি হাজির। ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদছে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ থমকে থাকল। আমাকে দেখে সংকোচ লাগছে হয়তোবা। দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগল না। গুটি গুটি পায়ে ভাইয়ের শিয়রের কাছে দাঁড়াল। হাত দিয়ে দাড়ি টেনে টেনে জাগিয়ে তুলল। আমি ভীষণ কৌতুহল নিয়ে ঘুমের ভান করে, পিটপিট করে তাকাচ্ছি। কয়েকবারের চেষ্টায় বড়ভাইয়ের ঘুম ভাঙল। চোখ মেলেই খুকিকে দেখলেন। ময়লা ছেঁড়া ফ্রক। নাকে শিকনি লেগে আছে। চোখের কোনে দুপুরের ঘুমভাঙা পিঁছুটি। ভাই মাথার কাছে রাখা জামা থেকে টিস্যু বের করলেন। পরমযত্নে চোখনাক মুছে দিলেন। খুকি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-আমাকে কুতুকুত খেলায় নিচ্ছে না।
-তাই নাকি! চল তো দেখি!
খুকির হাত ধরে বড়ভাই বেরিয়ে গেলেন। উদোম গা। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। পরে এসে গায়ে একটা গামছা চড়ালেন। আমি তাদের পিছু পিছু বের হলাম। ছানাবড়া চোখে দেখলাম, ভাই নিজের হাতে উবু হয়ে কুতকুতের ঘর টানলেন। পোড়ামাটির ভাঙা কলসের কোনাভাঙা দিয়ে। এগুলোকে খুকিরা বলে ‘চারা’। বড়ভাই মাদরাসায় আসা-যাওয়ার পথে, এসব চারা কুড়িয়ে আনেন। বাজার পার হয়ে আসার সময়, কুমোরপট্টির পাশ দিয়ে আসেন। খুকিদের জন্য ভাঙা ‘চারা’ সংগ্রহ করার জন্য। বুড়ো মানুষ, মাথাগুঁজে ‘চারা’ খুঁজছেন, সে এক দেখার মতো দৃশ্যই বটে।
ঘরটানা শেষ হলে, কষে লুঙ্গি পরে নিলেন। একটু পর সত্যি সত্যি খুকির সাথে কুতকুত খেলা শুরু করে দিলেন। এবার অন্য খোকা-খুকুরা এসে এখানে ভীড় জমাল।
.
জুমাবারে বিকেলে খালপাড়ের দিকে হাঁটতে বের হন। একটু পরপর ছটকা জাল পেতে বসে আছে লোকজন। কাছে গিয়ে তাদের সাথে গল্প জুড়ে দিলেন। একজনের নাম দুলাল। ছোটবেলায় কয়েক ক্লাস পড়েছে। এখন মাছ ধরে। ক্ষেতি-খামারি করে সংসার চালায়। আসার সময় দুলাল বড়সড় এক শোল মাছ ধরিয়ে দিল। মুখের ভেতর দিয়ে শক্ত ঘাসের ডগা ঢুকিয়ে কান ঘুরিয়ে বেঁধে দিল। বড়ভাই কিছুতেই নেবেন না। বারবার বলতে লাগলেন,
-আমি মাছ নিয়ে কী করব রে বেটা! আমাকে কে রেঁধে দিবে?
- হুজুর আমার বাড়ির পাক তো আপনি খাবেন না, নইলে রাজিবের মাকে বলতাম ভাল করে রেঁধে দিতে।
-আচ্ছা, তাহলে দাম দিয়ে কিনে নেব।
দুলাল একহাত লম্বা জিভ কেটে বলল,
-ভগবানের দোহাই লাগে হুজুর! গুরুর কাছ থেকে পয়সা নিলে অভিশাপ লাগবে!
- বেকুব, বেশি কথা বলিস! অভিশাপ কোত্থেকে আসবে শুনি? কে দেবে অভিশাপ? আমি খবর রাখি না মনে করেছিস? তোর ছেলেটা আজ ক’দিন ধরে অস্স্থু, ওষুধ কিনতে পারছিস না! আর তুই আমাকে মাছ বিলাচ্ছিস। নে ধর, টাকাটা রাখ। আর শোন, মফিজ ডাক্তারকে বলে রেখেছি, বিকেলে গিয়ে ওষুধ নিয়ে আসবি। তোর টাকা দেয়া লাগবে না। মনে করে যাবি কিন্তু! তোর শরমের কিছু নেই, আমি টাকা দিয়ে দিয়েছি। পরে হাতে টাকা এলে, আমাকে শোধ করে দিলেই হবে। আর শোন, রাজিব সুস্থ হলে, তাকে প্রতিদিন সকালে আমার কাছে পড়তে পাঠাস।
.
গ্রামে কয়েকঘর হিন্দু আছে। তাদের ছেলেমেয়েরাও বড়ভাইয়ের কাছে পড়তে আসে। তাদেরকে অবহেলা করেন না। যত্ন করে পড়া দেখিয়ে দেন। হাতের লেখা শেখান। বাংলা-অংক-ইংরেজি ধরিয়ে দেন। এই ছেলে-মেয়েরা ভাইয়ের প্রতি পরম কৃতজ্ঞতাবোধ নিয়ে বড় হয়। নানাভাবে তাদের কৃতজ্ঞতার প্রকাশ করতে তৎপর থাকে।
.
বৃহস্পতিবার। মাদরাসা আধবেলা। বারোটার দিকেই সব দরস শেষ। ভরদুপুরে জাঁ জাঁ রোদ্দুরে, মাদরাসা থেকে ফেরার পথে, ভীষণ পিপাসা পেল ভাইয়ের। এই একটা ব্যাপার, ক্ষুধা-পিপাসা বেশিক্ষণ সহ্য করে থাকতে পারেন না। গ্যাস্ট্রিক আছে। পেট খালি থাকলে চিনচিনে ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। আমি পেছনে সাইকেলের ক্যারিয়ারে। গ্রামের শুরুতেই হিন্দু বাড়ি। সাইকেল থামিয়ে নমিতা, নমিতা বলে ডাক দিলেন। লম্বা চিকন ঘোমটা টেনে নমিতা দৌড়ে এল। আসতে আসতে ভাইয়ের পায়ের উপর পড়ে প্রণাম করতে উদ্যত হল। ভাই লাফ দিয়ে সরে গেলেন। ধমক দিয়ে বললেন,
-তোকে কতবার নিষেধ করেছি, আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে আসবি না? পানির পিপাসা লেগেছে। কল চেপে একজগ পানি নিয়ে আয়। আর শোন, সাথে আর কিছুই আনবি না। বাতাসা বা নাড়ু কিছুই না। শুধু পানি আনবি। বাদল ঘরে আছে? তাকে আমার সাথে দেখা করতে বলিস!
.
নমিতা অনেক চেষ্টা করল, ভাইকে ঘরে নিয়ে বসাতে। ভাই রাজি হলেন না। নমিতা মরিয়া হয়ে বলল, অতিথি নিয়ে এসেছেন, না বসে গেলে, বড় অমঙ্গল হবে যে?
-বড়ভাই খেঁকিয়ে উঠলেন। রাখ তোর অমঙ্গল! মঙ্গল-অমঙ্গল তুই আমার চেয়ে বেশি বুঝিস? যা করতে বলেছি, তাড়াতাড়ি সেটা কর।
নমিতা বারণ শুনল না। পানি তো আনলই, সাথে প্লেটভর্তি শুকনো নাস্তা। অনুযোগ করে বলল, পানির পিপাসা ধরেছে বলে গরীবের ঘরে আপনার পদধূলি পড়েছে। ভগবান এভাবে প্রতিদিন আপনাকে পিপাসা দিন। হুজুর, আপনি প্রতিদিন আমার বাড়ির সামনে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যান, এক-আধদিন এখানে একটু থেমে গেলে কি আপনার আল্লাহ বেজার হবেন? নাতিটাকেও তো একবার দেখে যেতে পারেন। প্রতিদিন সকাল বিকাল আপনার যাওয়া-আসা দেখি। ভাবি, আজ বুঝি আমাদের ঘরের দিকে একবার হলেও তাকাবেন। কই, সামনের দিকে তাকিয়ে সাইকেল নিয়ে চলে যান। কত আশায় থাকি, নিজ থেকে এগিয়েও যেতে পারি না। তখন আপনি রাগ করে ভিনপথে মাদরাসায় যাবেন। ঘরে না এলেও, প্রতিদিন দু‘বার আপনাকে চোখের দেখা দেখি, তাতেই মন জুড়োয়। আপনাদের জামাই আপনাকে কত কত শ্রদ্ধা করে! গ্রামের সবাই মাসে একবেলা করে খাওয়ায়। আমরা হিন্দু বলে, যে সুযোগ পাই না। ওর খুব ইচ্ছা, মাসে একবেলা আপনি আমাদের বাড়িতেও খাবেন। আমারও বড় সাধ, মাসে অন্তত একবেলা আপনার টিপিন ক্যারিয়ার আমাদের বাড়িতে আসুক। আপনার দেখা না পেলেও, আপনার ভাতের বাটির দেখা তো পাচ্ছি, তাতেই আমরা মনকে বুঝ দিতে পারতাম। না না, আপনার ঘৃণা করার কিছু নেই।
-এই মুখপুড়ি, আমি ঘৃণা করে খাই না, সেটা তোকে বলেছি?
-ও বলেছিল, আপনার রান্না আমরা কোনও মুসলমান মেয়ে দিয়ে করাব। সেজন্য আলাদা, হাড়ি-পাতিলও কিনে এনেছে। সেগুলোতে মাসে শুধু একবার রান্না হবে। বাকি দিন দমদমে তোলা থাকবে। আপনার যদি এতেও মন সায় না দেয়, তাহলে আমরা খরচ দেব, কোনও মুসলিম ঘর থেকে রান্নার ব্যবস্থা হবে। নাকি তাতেও আপনার সায় নেই? আমরা হিন্দু বলে কি, আমাদের টাকাও হিন্দু হয়ে গেছে? টাকার আবার ধর্ম কিসের?
-ফাজিল মেয়ে! বেশি কথা বলিস! বাচ্চার মা হয়ে গেছিস এখনো আগের মতোই মুখরা রয়ে গেছিস! আচ্ছা আর বকবক করিস না, আমি ভেবেচিন্তে জানাব।
-চারটা ভাত খাবেন, এত ভাবাভাবির কী আছে? অত ভাবতে হলে, থাক দরকার নেই। কাজ নেই ‘হিন্দুভাত’ খেয়ে। আপনি আপনার ‘মুসলমানভাত’ নিয়ে থাকুন।
-আহা, রাগ করিস কেন! বললাম তো একটা ব্যবস্থা করব। বুঝিস না কেন, আমি সায় দিলেই হবে না। মসজিদকমিটিরও সায় থাকতে হবে। গ্রামে যদি রব ওঠে, হুজুরকে হিন্দুর ঘরে খেতে হবে কেন? মুসলমানরা কি তাদের হুজুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে পারে না? আরও নানা ফ্যাচাং! এসব তোর না বোঝার কথা নয়!
-আচ্ছা, খেতে না চাইলে সরাসরি বললেই হয়, এত ছুতোনাতা বের করার কী দরকার! এই প্যাকেটটা রাখুন।
-এটাতে কী আছে?
-এটা বাড়ির জন্য। মায়ের সাথে আমার কথা হয়েছে। ভেতরে কী আছে, সেটা ‘মা’ জানেন। আগে আপনাকে সবসময় না পেলেও, মাকে পেতাম। এখন কার কথা ধরে তাকেও আমাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছেন।
.
মাঝখানে কিছুদিন ভাবীকেও এখানে এনে রেখেছিলেন। তখন গাঁয়ের সবার সুখ-দুঃখের নিরাপদ অভয়স্থান ছিলেন ভাবী। যেসব সমস্যার সমাধান হুজুরের কাছে পাওয়া যায় না, ঘরে আম্মাজির কাছে গেলে, মিলে যায়। ভাইয়ের ছাত্রীরা একটু ডাগর হয়ে উঠলে ভাবীর কাছে পড়তে পাঠাতেন। ভাবী মেয়েদের পড়া দেখিয়ে দিতেন। কোথাও আটকে গেলে, ভাই বলে দিতেন। মেয়েরা ভাবীর কাছে স্কুলের পাঠের পাশাপাশি জীবনের পাঠও নিত। সমস্যা দেখা দিয়েছিল, ভাইয়ের মেয়েরা আস্তে আস্তে বিয়ের লায়েক হয়ে উঠছে। তাদের বিয়ে দিতে হবে। এখনো নিজের আলাদা করে কোনও ঘর হয়নি। ঘনিষ্ঠজনেরা পরামর্শ দিল, বিবিকে এখানে রাখলে, বাড়িতে ঘর ওঠানোর উদ্যোগ দুর্বল হয়ে থাকবে। বিবি ওখানে থাকলে, নিয়মিত বাড়িতে আসা-যাওয়া শুরু হলে, ঘরের তাকিদ বাড়বে। গ্রামবাসী প্রস্তাব দিয়েছিল, হুজুর যদি রাজি থাকেন, তাহলে এখানেই স্থায়ী ঘর করার ব্যবস্থা করে দেই? ভাই রাজি হননি। বাপদাদার ভিটে ছেড়ে কর্মস্থলে ডেরা বাঁধতে মন সায় দেয়নি।
.
মাদরাসা থেকে ফেরার পথে হিন্দুপাড়ায় কয়েকটা দোকান। নমিতার ঘরে পানি খেয়ে আবার সাইকেলে চড়ে বসলেন। ভাইকে আসতে দেখে সব দোকানের টিভি বন্ধ হয়ে গেল। সাইকেল থামিয়ে সবার সাথে সালাম-কালাম বিনিময় করলেন। সবার চায়ের জোর আবদার এড়িয়ে দ্রুত মসজিদের পথ ধরলেন। একটা কথা বড়ভাইয়ের মুখে সবসময় থাকে,
‘গুণির মান দেশে। আলেমের মান স্বদেশে ও বিদেশে’।
ভাই যেখানেই যান, সবাই সম্মানসমীহ করে। এমন আলাভোলা মানুষও ছাত্র-ভক্তদের বদৌলতে কয়েকটা দেশ সফর করে ফেলেছেন। যেখানেই গেছেন, আরব-অনারব সবাই অনেক ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা দেখিয়েছে। ভাই অল্পতেই আপ্লুত হয়ে যান।
.
ভাইয়ের সাথে বাজার থেকে ফিরছি। একদোকানে গেলেন। দোকানি দেখার সাথে সাথে ক্যাশবাক্স ছেড়ে তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেল। গামছা দিয়ে চেয়ার মুছে শশব্যাস্তে ভাইকে বসতে দিল। ভাই বললেন,
-না জসিম, বসব না। একটা পত্রিকা নিতে এলাম। অনেকদিন পত্রিকা পড়ি না। একটা পত্রিকা থাকলে দে।
জসিম দৌড়ে গিয়ে আজকের পত্রিকাটাই দিয়ে দিল। দেখলাম বিকেল হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ভাঁজ খোলা হয়নি। ‘তুই না পড়েই দিয়ে দিলি’? ‘আমার পড়া লাগবে না হুজুর। আপনি নিয়ে যান।
.
ভাই ঘরে ফিরে পত্রিকাটা নিয়ে বসলেন। গভীর মনোযোগের সাথে পত্রিকার এমাথা থেকে পড়লেন। মাঝেমধ্যে, কিছুদিন পরপর বাজার থেকে পত্রিকা এনে পড়েন। পুরনো পত্রিকা হলেও সমস্যা নেই। ভাইয়ের কথা হল, মাঝেমধ্যে পত্রিকা পড়ে, দুনিয়ার হাল-হাকীকত জানার চেষ্টা করি। হালচালের আঁচ নিই। জগতের গতি-প্রকৃতি কোনদিকে যাচ্ছে, সেটা জানা না থাকলে, চলবে কী করে? তবে প্রতিদিন পত্রিকা পড়া সময়ের অপচয়। কোনও কোনও সংবাদ বারবার পড়লেন। কোনও সংবাদ পড়েই খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠেন। কোনও সংবাদ পড়ে আফসোস করতে করতে জিভ ব্যথা করে ফেলেন। মতামত জানতে চান। এটা কেমন হল? লোকটাকে এভাবে খুন করে ফেলতে হবে? এত ছোট্ট একটি শিশুকেও জানোয়ারগুলো রেহাই দিল না? এভাবে চলতে থাকলে, কেয়ামত আসতে আর বেশি দেরী নেই।
.
ফজরের পর অনেক সময় নিয়ে শায়খের ওজীফা আদায় করেন। ইশরাক পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়েই তোড়জোড় শুরু করলেন। চলুন চলুন হেঁটে আসি। আসলে হাঁটার ছুতোয় আমাকে নাস্তা করাতে নিয়ে যাবেন। দোকানে গেলে, শিশুর মতো চায়ের কাপে পরোটা ডুবিয়ে পরম তৃপ্তিতে চুকচুক করে খেতে থাকেন। প্রথম পরোটা খান চিনি দিয়ে। পরোটা পিরিচে মেলে দিয়ে, একটু চিনি চেয়ে নেন। চিনি ছড়িয়ে দিয়ে পরোটা গোল করে পাকিয়ে নেন। অমৃতের মতো খেতে থাকেন।
.
তারপর হাঁটতে হাঁটতে খালের পাড়ে যান। আজ খালপাড়ের দিকে না গিয়ে, উল্টোদিকে হাঁটা ধরলেন। ওদিকে বড়বিল। গ্রাম ছাড়িয়ে দিগন্তবিস্তৃত জলার পর জলা। হঠাৎ বৃষ্টিতে চারদিক ছাপিয়ে সাগর হয়ে গেছে। কয়েকদিনের পানিতে লকলকিয়ে শাপলা উঠেছে। পানির উপরে ভেসে থাকা শাপলা ফুলগুলো মুখ হাসি হাসি হয়ে আছে। ছোট্ট একটা কালভার্ট আছে। সেখানে গিয়ে বসলেন। হু হু দখিনা বাতাস বইছে। পাথারের মাঝে একটি ডিঙ্গি দোল খাচ্ছে। দূর থেকে আবছা দেখা যাচ্ছে, একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। বড়বড় ঘাসের আড়ালে ডিঙ্গি থামিয়ে পানি থেকে কী যেন তুলছে। বড়ভাই জোরে ডাক দিলেন,
-হাশেম! হাশেম!
আচানক ডাকে হতচকিত হয়ে সেদিকে তাকালাম। ডিঙ্গিটা ধীরে ধীরে এদিকে আসছে। ছেলেটা দাঁড় বাইছে। দূরে থাকতে মেয়েটাও বৈঠা বাইছিল। কাছে আসার পর, ওড়না দিয়ে নিজেকে ঢেকে, উল্টোদিকে মুখ ফিরিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। ভাইয়ের কাছে জানতে পারলাম, হাশেম আর যয়নব ভাইবোন। বাবা বিদেশে গিয়েছিলেন। যয়নবের জন্মের পরপরই। দীর্ঘদিন ধরে বাবার কোনও খোঁজ-খবর নেই। উড়োখবর, মারা গেছে। স্বামী হারিয়ে দুই শিশু নিয়ে বিধবা আমেনা চোখে আঁধার দেখল। কিছুদিন জমানো টাকায় চলল। টাকা ফুরোলে, বড়ভাই গ্রামের সবাইকে ধরে, গণচাঁদার ব্যবস্থা করে দিলেন। হাশেমের মা চাঁদা নিতে বিনয়ের সাথে অস্বীকৃতি জানালেন। কাঁথা সেলাই আর মুস্তাক পাতার চাটাই বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করবেন বলে জানালেন। সেই থেকে এভাবে চলছে।
.
যয়নব গ্রামের হেফযখানায় হেফয শেষ করেছে। কিতাব বিভাগে ভর্তি হয়ে এখন হেদায়াতুন নাহু পড়ে। হাশেম বোনের সাথে একই জামাতে পড়ে। হেফযখানায় সে বোনের তুলনায় একটু বেশি সময় নিয়ে ফেলাতে, ছোটবোনের সাথে জামাত মিলে গেছে। দু’জনই বড়ভাইয়ের কাছে মক্তবে পড়েছে। বড়ভাই জানতে চাইলেন,
-পরীক্ষার ফিসের টাকা জোগাড় হয়েছে?
-জি¦ না হুজুর। আর তিনদিন লাগবে।
এতক্ষণ মনে পড়ি পড়ি করেও মনে পড়ছিল না। গতকাল আমরা যখন সকালে দোকানে নাস্তা করছিলাম, তখন হাশেমকে দেখেছিলাম। শাপলার তোড়া হাতে দোকানের সামনে দিয়ে যেতে। আমাদের দেখে তার লাজুক হাসিটাও চোখে লেগে আছে। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, কেন লাজুক হেসেছিল। শাপলা বিক্রি করে পরীক্ষার ফি জোগাড়ে নেমেছে। চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, একসময় বড় আদরে আহ্লাদে বড় হয়েছে। এখন জীবনের তিক্ত তাগিদে শাপলা ফেরি করে বেড়াতে হচ্ছে। বড়ভাই বললেন,
-শাপলা কত করে বিক্রি করিস?
-একতোড়া দশ বা পনেরটাকা।
-আচ্ছা ঠিক আছে, আমি যয়নবের ফি’টা দিয়ে দেব। তুই তোরটা জোগাড় কর।
.
ফিরতি পথে কিছুদূর চলে আসার পর, হাশেম দৌড়ে এল। হাতে বেশক’টা ‘বেট’। শাপলাফল। ভেতরে গুড়োগুড়ো দানা থাকে। গ্রামের বাজারে ফুলের মতো ‘বেটও’ বিক্রি হয়। শাপলাডগা রান্না করে খাওয়া হলেও, ছেলেপিলেরা ‘বেট’ কাঁচা চিবিয়ে খায়। বেশ মজা। প্রথমে হালকা তিতকুটে লাগলেও, পরে কষকষ স্বাদ লাগে। শাপলাডগার চেয়ে ‘বেটের’ দাম বেশি। হাশেম আমার দিকে পাঁচটা বেট এগিয়ে দিল। বড়ভাই বললেন,
-তোরা সাতসকালে কষ্ট করে এগুলো কুড়িয়েছিস। আমাদের দিয়ে দিলে বিক্রি করবি কী? নিয়ে যা, আমাদের লাগবে না। আর যদি নিতেই হয়, কিনে নেব।
-হুজুর, না নিয়ে যয়নব বড় কষ্ট পাবে। আপনি না নিলে, অন্তত মেহমানের দিকে দিকে তাকিয়ে হলেও নিতে বলেছে।
আমি চমকে উঠলাম। কিশোরীর তাহলে মেহমানের দিকেও নজর আছে। বাহ! বেশ, বেশ! কেন যেন মনটা অচেনা আনন্দে খলবল করে উঠল। দুষ্ট মনের আর কাজ কী! এমন পীড়াপীড়ির পর, উপঢৌকন গ্রহণ না করাটা, জুলুম হয়ে যাবে। সেই ছেলেবেলার মতো, হাঁটতে হাঁটতেই, অচেনা কিশোরীর ‘মায়াবী’ উপহার সৎকারে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
‘‘পৃথিবীর কোনো পথ এ কন্যারে দেখেনিকো দেখি নাই অত
অজ¯্র চুলের চুমা হিজলে কাঁঠালে জামে ঝরে অবিরত,
জানি নাই এত স্নিগ্ধ গন্ধ ঝরে রূপসীর চুলের বিন্যাসে
.
পৃথিবীর কোনো পথে; নরম ধানের গন্ধ-কলমীর ঘ্রাণ,
হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদা সরপুটিদের
মৃদু ঘ্রাণ, কিশোরীর চাল ধোয়া ভিজে হাত-শীত হাতখান,
.
মাগরিব পড়ে বড়ভাই সাধারণত কিতাব মুতালায়ায় মশগুল হয়ে পড়েন। কোথাও যান না। কারও সাথে কথা বলেন না। আজ বৃহস্পতিবার। আগামীকাল মাদরাসা নেই। মসজিদ থেকে বের হয়ে হুজরার দিকে না গিয়ে, অন্যদিকে হাঁটা ধরলেন। বিনাবাক্যব্যয়ে পিছু নিলাম। গ্রামের শেষমাথার একবাড়িতে গিয়ে উঠলেন। হাশেম বলে জোরে হাঁক দিলেন। কোনও সাড়াশব্দ নেই। একটু পর ভেতর থেকে আওয়াজ এল,
-ভাইয়া বাজারে গেছে!
বড়ভাই ফিরে যেতে উদ্যত হতেই কোত্থেকে হন্তদন্ত হয়ে হাশেম হাজির হল। ঘরে গিয়ে বসলেন। বড়ভাই সময় পেলে দু’জনকে মাঝেমধ্যে পড়াতে আসেন। বেশিরভাগ সময় হাশেম মাগরিবের কিতাবপত্র নিয়ে ভাইয়ের কাছে চলে আসে। আর যয়নবের কোনও কিতাব বোঝার প্রয়োজন হলে, বড়ভাই সপ্তাহে একদিন গিয়ে যয়নবকে পড়া বুুঝিয়ে দিয়ে আসেন। পর্দার এপাশে হাশেমকে পড়াটা বুঝিয়ে দেন। পর্দার ওপাশ থেকে যয়নব সে পড়া ধরে। আজও তেমন হল। বড়ভাই আগের সপ্তাহে প্রশ্ন দিয়ে গিয়েছিলেন। আজ ভাইবোনের খাতা দেখলেন। ভাইয়ের চেয়ে বোনের হাতের লেখা বেশি সুন্দর। উত্তরও দেখা গেল, যয়নব ভাইয়ের চেয়ে বেশি ভাল লিখেছে। যয়নবের খাতা দেখে, তার পড়ার গুণপনা দেখে, কেন যেন বুক চিরে একটা দীর্ঘশ^াস বেরিয়ে এল। মেয়েটার কুরআন তিলাওয়াত শোনার জন্য মনটা রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করেছিল। বড়ভাই রাজি হবেন না, তাই মনের সাথে কুস্তি লড়ে, জব্বর হয়ে বলী লড়ে, মনকে ধরাশায়ী করতে হয়েছে।
.
বিসমিল্লাহ খাঁর কাছে সানাই শেখা বড় ঝকমারি ব্যাপার ছিল। তার কাছে শিখতে গেলে হরবকত তটস্থ হয়ে থাকতে হত। ওস্তাদ কখন শেখাতে আসবেন, কখন ওস্তাদের ‘মুড’ অফ থাকবে, আগে থেকে বলা যায় না। দেখা গেল রাত দু’টোয় যখন সবাই গভীর ঘুমে তলিয়ে, তখন ওস্তাদের শেখানোর মুড চাগাড় দিয়ে উঠল। দোতলা থেকে নেমে এলেন। ছাত্রদের ঘুমুতে দেখে কিছু না বলে চুপচাপ চলে গেলেন। এরপর সপ্তাহের পর সপ্তাহ ওস্তাদের দেখা নেই। ছাত্রমহলে মৃদ গুঞ্জরণ! কী হল! কী হল? খবর বের হল, ওস্তাদ একদিন রাত দু’টোয় এসেছিলেন। শাগরেদরা তখন রেওয়াজ না করে, পড়ে পড়ে সাঁটিয়ে ঘুমচ্ছিল। ব্যস গুরুটি রেগে টং।
.
বড়ভাইও হুবহু তেমন না হলেও, কিছুটা মিল আছে। তার মাথায় সবসময় কুরআন ঘোরে। তিনি বহুবছর ধরে তাফসীরে জালালাইন পড়াচ্ছেন। পুরো কুরআনের প্রতিটি লাইন তার চোখদর্পণে। তার চিন্তাগুলো ঘুরপাক খায়, মিশকাত ও জালালাইনের ধাঁচে। দীর্ঘদিন ধরে কিতাবদু’টো পড়াচ্ছেন। পড়াতে পড়াতে, তার কাজকর্মের উপর দুই কিতাব ভীষণভাবে প্রভাব বিস্তার করে আছে। মাঝেমধ্যে তাঁর উষ্ণ সান্নিধ্যে থাকতে আসি। আমরা দু’জনে বয়েসে অসম হলেও, তাফসীরের ক্ষেত্রে এক ওস্তাদের শাগরিদ। তার তাফসীরের চিন্তাগুলোর ধরন পরিচিত। রাতে আমরা পাশাপাশি ঘুমুই। তিনি খাটের উপর, আমি নিচে। রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। চোখ কচলে পিটপিট করে তাকালাম। তাহাজ্জুদের সময় হয়ে গেছে। ভাই কিছু বলার জন্য ঘুম থেকে ডেকে তুলেছেন। একটা আয়াতের কথা মনে পড়েছে। তাই না বলে থাকতে পারেননি। মাঝেমধ্যে এমনও হয়, গভীর রাতে ভাবীর কাছে ফোন করে, ভাবনার কথা জানান। ভাবী এতে অভ্যস্ত। শুরু হয় কুরআন দিয়ে, সমাপ্ত হয়, গভীর দাম্পত্যালাপ দিয়ে। ফোনের ওপাশে কী হয় জানি না, এপাশে ফোন রেখে ভাই চোখ মোছেন। প্রতি সপ্তাহান্তে একবার দেখা হয়, তারপরও সপ্তাহের মাঝামাঝিতে দু’জন-দু’জনার কথায় স্বামীর চোখ পানি আসে, বেশ অবাক করা ব্যাপার। কী এমন কথা হয় তাহার সনে? চোখে পানি আসে? বালিশের উপর হাতের কাজ করা এক তোয়ালে। তাতে লেখা ‘ভুলো না আমায়’। বালিশের কভারের উপর হাত বোলাতে থাকেন। যেন দূর থেকে বিবির ছোঁয়া পেতে চাইছেন। এভাবে বিরহ যাতনাও কিছুটা লাঘব হয় বোধ হয়। ভাইয়ের মোবাইলটাও সেই আদিকালের নোকিয়া। এটার কভার এখন বাজারে পাওয়া যায় না। ভাবী নিজ হাতে কাপড় দিয়ে কয়েকটা সুন্দর কভার বানিয়ে দিয়েছেন। ভাইকে দেখি, প্রতিবার কথা বলার সময়ম পরম মমতায় মোবাইলটা মুখের সাথে লাগাচ্ছেন। প্রিয়ার স্পর্শমাখা মোবাইল বলে কথা। প্রতি সপ্তাহে বাড়ি গেলে, ভাবী কাপড় ধোয়ার সাবান দিয়ে কভারটা ধুয়ে দেন। তারপর আতরমাখিয়ে সুরভিত করে দেন। ভাই তার মোবাইলে কাউকে কথা বলতে দেন না। নিজের হাতছাড়া করতে চান না। একান্তই কাউকে কথা বলতে দিতে হলে, কভার খুলে নেন। বড়ভাই এক বেদুইনের গল্প বলেন,
‘বেদুইনদের কাফেলা চলছে। মরুভূমির বুক চিরে। ধূ ধূ বালুকারাশি। এক পথহারা পথিক পড়ল সামনে। তার সওয়ারি মারা গেছে। লোকটাও অসুস্থ। হাঁটতে পারছে না। বাহন দরকার। বেদুইনের কাছে দু’টি উট। একটিতে নিজে, আরেকটিতে বিবি। বদু ঠিক করল, একটা উট মুমূর্ষ মুসাফিরকে ছেড়ে দেবেন। বিবিকে নামিয়ে, পানি দিয়ে ওটের পিঠটা ধুয়ে দিলেন। মুসাফির অবাক। পানির জন্য এত হাহাকার, ওটের পিঠ ধোয়ার কী দরকার ছিল? বদুর সতেজ উত্তর,
-আমি চাই না, আমার বিবির উষ্ণতা পরপুরুষের গায়ে লাগুক।
বড়ভাই বলেন, আমার বিবির ছোঁয়ামাখা কাপড় আরেক বেগানাকে ধরতে দেব কেন?
.
ভাইয়ের কাছে ভাবী সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। কোনও দ্বিধা ছাড়াই বললেন,
-আমি চালচুলোহীন মানুষ। এমন অসাধারণ একজন মানুষকে জীবনে পেয়েছি। আমি এমন মানুষকে জীবনসঙ্গী হিশেবে পাওয়ার যোগ্য ছিলাম না। একমাত্র আল্লাহর খাস রহমতেই এটা সম্ভব হয়েছে। আল্লাহর প্রতি গভীর শুকরিয়াতেই চোখে পানি আসে।
-ভাবি কাঁদেন না?
-সুবহানাল্লাহ! ওই মানুষটা তো আমাকে চোখের আড়াল করতেই ‘ডরডর’ করে কেঁদে দেন। সবসময় বলে, আমি তার জীবনে আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া শ্রেষ্ঠতম ‘হাসানাহ’। দুনিয়ার আর কিছু না পেয়ে, শুধু যদি আমাকে পেতেন, তাহলে তাঁর আর পাওয়ার কিছু থাকত না।
.
.
(চলবে ইনশা আল্লাহ)
(please visit our website for part 2)

কোন মন্তব্য নেই

nicodemos থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.