যে গল্পে ঽদয় গলে-You must read (part 2 End)
দোস্ত, জানেমান!
(উপন্যাসিকা)part End
(উপন্যাসিকা)part End
ভাবীর সাথে কথা বলার সময়, ভাইয়ের আর কোনওদিকে হুঁশ থাকে না। ভাবীও কম যান কি সে! প্রচণ্ড গরম পড়ছে। ভাবীর ফোন। ‘এই গরমে মাদরাসা থেকে এতদূর সাইকেল চালিয়ে ফিরলেন। কষ্ট লাগছে না? কাছে থাকলে পাখা বিছিয়ে বাতাস করে দিতাম,’
-বাড়ি চলে আসতে বলছ?
-আসবেন?
-মন চাইছে উড়ে যাই। কিন্তু আজ সম্ভব নয়। এককাজ করলে কেমন হয়? তুমি ওখান থেকে বাতাস কর।
-কোথায় বাতাস করব?
-নিজেকেই? আমি এখানে পাঞ্জাবী কুলে আদুল গায়ে বসি। দেখবে, তোমার পাখার বাতাস এতদূরে এসেও আমাকে শীতল করে দেবে।
-আপনি মাঝেমাধ্যে এমন এমন কথা বলেন! ঠিক আছে। বাতাস করা শুরু করেছি।
ভাই সত্যি সত্যি জামা খুলে ফেললেন। ফোনে আহ! আহ করতে লাগলেন। আচ্ছা রেহানা, আমি উদোম হয়ে বাতাস খাচ্ছি। আহ সব শীত হয়ে গেল রে! এবার ঠা-া লেগে গেল বুঝি, হ্যাঁচ্চো!
এই বুড়ো বয়েসেও এত প্রেম কোত্থেকে যে আসে! ভাইয়ের দাড়ি প্রায় সবই শাদা হয়ে গেছে। মাথার চুলগুলো অবশ্য আধপাকা।
.
সতের বছর মেশকাত আউয়াল পড়িয়েছেন। বয়যাবি শরীফ পড়ান কয়েক বছর ধরে। প্রথম বছর, সবক বণ্টন করার দিন, কথা উঠল বড়ভাই ছাত্রজীবনে বয়যাবি শরীফ পড়েননি। নাজেম সাহেব ডেকে পাঠালেন,
-হুজুর, শুনলাম আপনি বয়যাবি পড়েননি, এখন পড়াবেন কী করে?
-হুজুর, বয়যাবি শরীফের মুসান্নিফ, নিজে না পড়ে যদি, বয়জাবি লিখতে পারেন, আমি কেন পড়াতে পারব না?
এরপর আর কথা চলে না। বৃক্ষ তোমার নাম কী? নাম দিয়ে কী হবে, ফলে পরিচয়। সুযোগসন্ধানীরা শতচেষ্টা করেও খুঁত ধরতে পারল না। অবাক করা ব্যাপার, ভাইয়ের মতো এমন ফিরিশতাস্বভাব মানুষেরও শত্রু থাকে? কেন নবীজি সা.-এর শত্তুর ছিল না? ছাত্ররাও ভাইয়ের কাছে বয়যাবি পড়তে পেরে খুশি। শুধু পড়ান তো না, রীতিমতো গুলে খাইয়ে দেন।
.
বড়ভাই কথায় কথায় তার শায়খের উক্তি বলেন। ফজরের পর হাঁটতে বের হয়েছি। ভাই তার শায়খের কথা বললেন,
আল্লাহকে পাওয়ার তিনটি উপায়,
ক: সোহবতে আহলুল্লাহ। আল্লাহঅলাদের সাহচর্য।
খ: তাফাক্কুর ফী খালকিল্লাহ। আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা।
গ: কাসরতে যিকরুল্লাহ। বেশি বেশি আল্লাহর যিকির।
আমি আরেকটা ধারা যোগ করি,
ঘ: জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ।
.
দু’জন বের হয়েছি। হাঁটতে হাঁটতে বৃষ্টি এল। বেশিদূর যাওয়া হল না। দৌড়ে মসজিদে ফিরলাম। প্রতিটি ঘটনায় ভাইয়ের মন্তব্য থাকে। বৃষ্টি দেখে তার শায়খের কথা বললেন,
‘আকাশ হল স্বামী। যমীন হল স্ত্রী। বৃষ্টি হল ‘বীর্য’। বৃষ্টির মাধ্যমে যমীনের সন্তান হয়। মানুষের সন্তান একরকম হয়। একধরনের নয়। আকাশের বীর্যে অসংখ্য সৃষ্টির বীজ লুকিয়ে থাকে। যমীনের ডিম্বাশয়েও অগণিত প্রাণীর উৎস বিদ্যমান থাকে। এক বৃষ্টি দিয়ে হাজারো প্রাণ সৃষ্টি হয়। এক উদরে লাখো প্রাণীর জন্ম হয়।’
আল্লাহঅলাদের দৃষ্টিই আলাদা। তারা সবসময় আল্লাহর চিন্তায় বিভোর থাকেন। আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে ভাবনার অতলে ডুবে থাকেন। ডুবে ডুবে সৃষ্টিরহস্য নিয়ে মজে থাকেন। ভাইও, যেখানে যা দেখেন, সবকিছুতে কীভাবে যেন রাব্বে কারীমের ‘কুদরত’ আবিষ্কার করে ফেলেন। সবকিছুতো আল্লাহপাকেরই তৈরি। কিন্তু সেটাকে গ্রহণযোগ্য বক্তব্যে প্রকাশ করতে পারেন ক’জন?
.
রাস্তায় বের হলে ভাই একনাগাড়ে সালাম দিয়েই যান। ছেলেবুড়ো, শিশু-কিশোর সবাইকে। কোনও বাছবিচার ছাড়াই। নাম ধরে হাল-কুশল জানতে চান। গ্রামের সবার নাম জানেন। সবাই তাঁর দোস্ত। যাকেই দেখেন,
-কী দোস্ত, কী খবর?
বিবিকে ফোন করেও সালাম দিয়ে বলেন,
-দোস্ত কী খবর?
প্রথম প্রথম শুনতে বেশ অবাক লাগে। কারও কারও হাসিও পায়। বিবিকে দোস্ত ডাকছেন যে? ভাইয়ের সরল উত্তর,
-বিবির চেয়ে বড় দোস্ত আর কে আছে? বিবির সাথে দোস্তি করা ফরয। বিবির সাথে দোস্তি না করলে, আল্লাহর নারাজ হন। আল্লাহর রাসূল সা. নারাজ হন। সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম বিবির সাথে দোস্তি করে গেছেন। আমাদের পেয়ারা নবীজি আম্মাজানদের সাথে দোস্তির জীবন কাটিয়ে গেছেন। তাদের সাথে দোস্তে মতো হাসিগল্প করেছেন। খেলাধূলা করেছেন। বিবির সাথে দোস্তির যে মজা, অন্য কারও সাথে দোস্তিতে কি সেই মজা আছে? বিবি হলেন হালাল দোস্ত। তার সাথে সবকিছু করা হালাল। দোস্ত শব্দটা এসেছে ফার্সি থেকে। ‘দো’-দুই আর ‘আস্ত’-অস্তিত্ব থেকে। মানে দুই অস্তিত্ব একসাথ হওয়াকে দোস্তি বলে। আমাকে বলুন তো দোস্তরা, বিবি ছাড়া আর কোন দোস্তির মধ্যে ‘দুই অস্তিত্ব’ এক হয়?
.
ভাইয়ের কাছে টাকা থাকে না। ফোনেও ব্যালান্স থাকে না। সবার খোঁজ-খবর করতে করতে, কোন ফাঁকে টাকা ফুরিয়ে যায়, টেরও পান না। প্রতিবেশির খোঁজ রাখা কুরআনি দায়িত্ব। সশরীরে গিয়ে দেখা করা সম্ভব নয়, অন্তত ফোনে হলেও দু’চার কথা বলে, কুরআনি আমল জারি রাখেন। ভাবী বুধবারে ফোন করলেন। বাড়ি যাওয়া দরকার,
-আমার কাছে ভাড়ার টাকা নেই। শুক্রবারে জুমা আছে। এখন কীভাবে আসি!
-আপনি আসুন। আমি ভাড়ার টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ফোনে কথা শেষ করে, ভাই লাজুক হেসে বলেন,
-বুড়ো হয়ে গেছি, এখন ঘন ঘন বাড়ি গিয়ে কাজ কী? তা না, প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যাওয়ার আবদার জুড়বে। না গিয়েও পারি না। শুক্রবারে ধেয়ে ধেয়ে এসে কোনওমতে জুমা ধরতে হয়। এই তো ক’দিন আগে বাড়ি গেলাম। তারপরও বাড়ি গেলে এমনভাবে গ্রহণ করে, যেন বহুদিন পর বাড়ি এসেছি। শুক্রবারে জায়গীর বাড়িতে ফেরার সময়, কিছু না কিছু বানিয়ে দেবেই। আজ কত বছর হয়ে গেল, কখনো এর ব্যতিক্রম হয়নি। বিদায় দেয়ার সময়, এখনো সেই প্রথম দিকের মতোই মনখারাপ করা ভঙ্গিতে বিদায় জানায়। যেন চিরদিনের জন্য দেশান্তরে যাচ্ছি। আর কখনো ফিরব না। পইপই করে বলে দেয়, আগামী বৃহস্পতিবারে যেন, জোহরের আগে ঘণ্টা শেষ করেই বাড়িতে চলে যাই। সকালে মাদরাসায় যাওয়ার সময়ই যেন, জায়গীর বাড়িতে বলে যাই। সপ্তাহে একটা দিন একসাথে থাকি। যতটা সম্ভব সময়টা বাড়িয়ে নিতে চায়। বৃহস্পতিবারে দিনে দিনে গেলে, দু’জন কিছুটা সময় বেশি পেলাম। আগে শুক্রবারে আসার সময় আলাদা করে দুই ভাড়ার টাকা দিয়ে দিত। সেদিনের ফেরার ভাড়া আর পরের সপ্তাহে বাড়ি যাওয়ার ভাড়া। প্রতি সপ্তাহ শেষেই দেখা যেত, ভাড়ার টাকা নেই। ভাবী আবার নতুন করে পাঠান।
.
ভাইয়ের কথাটা শুনে চমকে উঠলাম। ভাই বললেন,
‘আল্লাহর জন্য আমার শুধু পরান পোড়ে। আল্লাহকে যে কখন দেখব! আল্লাহ আমাকে কতকিছু দিয়েছেন! কত নেয়ামতে ডুবিয়ে রেখেছেন।’
দুপুরে একা একা তাফসীরে বয়যাবীর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে, গালে হাত দিয়ে ভাবি, আল্লাহর জন্য প্রাণ কাঁদে, এমন অভিনব কথা কীভাবে বলতে পারলেন? এভাবে ভাবতে পারলেনই-বা কীকরে? শুধু মুখের কথা তো নয়, বাস্তবেই তিনি অনুক্ষণ আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকেন। মুখ খুললেই আল্লাহর কথা বের হয়। এভাবে তো কাউকে বলতে শুনিনি। আল্লাহর জন্য প্রাণ কাঁদে? এত সহজে এমন গভীর কথা, কীভাবে ভাই বলতে পারলেন? কথাটা যতই ভাবি, গা-শিউরে ওঠে। আল্লাহর প্রতি মহব্বত কতটা গভীর হলে, এভাবে বলা যায়? রাব্বে কারীমের যিকির কলবে কতটা জাগরূক থাকলে, আল্লাহর জন্য কারও প্রাণ কাঁদতে থাকে? আল্লাহর প্রতি বান্দার ভালোবাসার চূড়ান্ত রূপ কী? আল্লাহর জন্য, আল্লাহর দীদার লাভের জন্য বেচাইন-ব্যাকুল হয়ে ওঠা?
.
বড়ভাই থাকেন মসজিদের লাগোয়া ছোট্ট একটি কুঁড়েঘরে। পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে সোজা ‘দুধগঞ্জ’ বাজারের দিকে। প্রায়ই ভাত খেতে বসার আগে, দরজার গিয়ে দাঁড়ান। কোনও রিকশঅলা দেখলে ডেকে আনেন। জোর করে খেতে বসান। বলেন, মেহমান নেওয়াজি নবীঅলা গুণ। নবীগণ সবাই মেহমান নেওয়াজ ছিলেন। খানা একজনের হলেও, দু’জনে খেতে কোনও সমস্যা নেই। খেতে খেতে বলেন
‘যত হাত তত বরকত।’
গরীব রিকশাঅলা হুজুরের সাথে ভাত খেতে পেয়ে, বর্তে যেত। বাজারে এমন কোনও রিকশাচালক নেই, যে ভাইয়ের সাথে ভাত খেতে বসেনি। শুধু কি রিকশাঅলা? হুদিনে (শুকনোর মওসুমে) ভিনদেশ থেকে মাছ ধরতে আসা পেশাদার জেলেরাও ভাইয়ের দস্তরখানায় ঠাঁই পেত। গ্রীষ্মকালে পুকুরের পানি শুকিয়ে এলে, গেরস্তরা পুকুড়ে বেড় দিয়ে মাছ ধরে ফেলে। সামনে বর্ষা নতুন মাছ ঢুকবে। বর্ষা গেলে নতুন পোনা জিয়োবে। হয়তো পুকুরের পানি সেঁচে, আরেকটু গভীর করবে। ডাক পড়ে জেলেদের। জেলেরা সদলবলে এসে মাছ ধরে দিয়ে যায়। কাজ শেষ হলে পুকুরপাড়ে রান্না চড়ায়। জাল শুকোতে দেয়। আজকের বেড়ে জাল কোথাও ছিঁড়ে গেলে, সেটা ‘তুনে’ (সেলাই করে)।
.
বড়ভাই দুপুরে খেতে বসার আগে ‘মেহমান শিকারে’ বের হন। বের হয়েই দেখলেন, জেলের দল তাদের ‘জালসংসার’ পেতে বসেছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক যে, তাকে ‘শিকার’ করে আনলেন। জেলেবুড়ো অবাক। হুজুর তাকে খেতে ডাকছেন? হুজুরের ঘরে, হুজুরের সাথে বসে একজন জেলে ভাত খাবে? এমন ঘটনা যে আগে কখনো ঘটেনি। কেউ কখনো এভাবে আদর করে ডাকেনি যে! জেলেখুড়ো অভিভূত। হুজুর শুধু পেটই ভরিয়ে দেননি। মনও ভরিয়ে দিয়েছেন। সে হিন্দু জেনেও, অবহেলা করেননি। কত মুসলমানের বাড়িতে এই জীবনে ‘বেড়’ দিয়েছি, কত হুজুরে বাড়িতেও গিয়েছি, কই কেউ তো এভাবে আল্লাহর কথা বলেননি। স্বর্গ-নরকের কথা বলেননি?
হারাধান জেলে ভাইয়ের দোচালা ঘর থেকে বের হতে হতে কী এক ভাবনায় ডুবে গেল। হুজুর তাকে বাড়িতে যাওয়ার দাওয়াতও দিয়েছেন। বাড়ির পুকুরের মাছ ধরতে হবে। সাথে আরতির মাকেও নিয়ে যেতে বলেছেন। এতটা আদর কোনও মুসলমানের কাছে আগে পায়নি।
.
ভাই তিনটা কথা বললে, তারমধ্যে একটা কথা ভাবীকে নিয়ে থাকবেই। এমন ‘মজনুস্বামী’ আর দেখিনি। ভাবীওবা কম যান কিসে। তাঁর ফোনের বহর দেখলে মনে হয়, তার আর কোনও কাজ নেই, একটু পরপর ভাইয়ের সাথে কথা বলাই তার জীবনের একমাত্র ধ্যানজ্ঞানযপ। আসলে ব্যাপারটা এমন নয় মোটেও। ভাবী খুবই বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন এক পরিপূর্ণ নারী। দক্ষ হাতে ঘর-সংসার আগলান। নিপুণ নৈপুণ্যে দশদিক সামলান। দোষের মধ্যে, স্বামীর প্রতি যুক্তিতক্কগপ্পোতীত ‘মহব্বত’।
.
ভাইয়ের দিন শুরু হয় ভাবীকে দিয়ে। শেষও হয় সেখানে। কী এক মোহময় নেশায় যে দু’জনে অহর্নিশি বুঁদ হয়ে থাকেন। তাদের মনোজগতে দু’জন ছাড়া ভিন্ন কেউ আছে বলে মনে হয় না। একে অপরের পরিপূরক। যা করার দু’জন মিলে করেন। যা ভাবার দু’জন মিলে ভাবেন। ভাইয়ের কর্মপরিধির পুরোটা জুড়েই ভাবী থাকেন। ভাবীর পুরোটা জুড়েও ভাই থাকেন।
.
ভাবী ফোন করতে দেরি করলে, ভাই নিজেই অস্থির হয়ে ফোন করেন। একেকবার ফোন করে, অতিজোশের সাথে বলে উঠেন,
صَدَقْتَ يا رَسُوْلَ اللهِ
হে আল্লাহর রাসূল! আপনি সত্য বলেছেন।
প্রথম প্রথম অবাক হয়ে তাকাতাম। একটু পরপর একথা কেন বলেন? একদিন থাকতে না পেরে, ফস করে প্রশ্নটা করেই ফেললাম। ভাইয়ের মুখে নির্মল হাসি। কিছুটা লাজুকও বটে।
-যতবারই দোস্তবিবির সাথে কথা বলি, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লামের একটা হাদীসের কথা মনে পড়ে,
الدُّنيا كلُّها متاعٌ، وخيرُ متاعِ الدنيا المرأةُ الصالحةُ
দুনিয়ার পুরোটা জুড়েই নানা ভোগ-উপভোগের বস্তুর ছড়াছড়ি। সম্পদ-সম্পত্তির জড়াজড়ি। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম অমূল্য ‘সম্পদ’ হল নেককার ‘বিবি’ (মুসলিম শরীফ ১৪৬৭)।
আমার পেয়ারা নবীজি সাদিক। সত্যবাদী। আমার পেয়ারা নবীজি ‘আমীন’। বিশ^স্ত। আমানতদার। তিনি যা বলে গেছেন তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। আমি যদি ইসলামের অন্য কিছুই না জেনে শুধু নবীজির এই হাদীসটা জানতাম, তাহলেই বুঝতে পারতাম, ইসলাম সত্য। ইসলামের নবী সত্য। আমার দোস্তকে পাওয়ার পর ইসলামের সত্যতার আকীদা আরও পোক্ত হয়েছে। যতবার আমার জানপরান দোস্তের সাথে কথা বলি, ততই আল্লাহর প্রতি মহব্বত আগের তুলনায় বৃদ্ধি পায়। পেয়ারা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি মহব্বত বেড়ে যায়।
.
আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ফয়দা করেছেন। আমাদের আদি পিতামাতা আদম ও হাওয়া আ.-কে সৃষ্টি করেছেন। আমাদের জন্য বিয়ের মতো অপূর্ব একটি ব্যবস্থা চালু করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা যদি এই বিয়ের বিধান না দিতেন, তাহলে আমি কি বিয়ে করতাম? আমি কি আমার দোস্তকে পেতাম?
.
আল্লাহর রাসূল কতবড় মানুষ। তারপরও তিনি আম্মাজানগনের সাথে কী সুন্দর মহব্বতপূর্ণ দাম্পত্য জীবন কাটিয়ে গেছেন। আমাদের জন্য অনুপম আদর্শ রেখে গেছেন। আমাদের সামনে জীবন্ত নমুনা কায়েম করে গেছেন। বিবির প্রতি অন্যায় আচরণ করতে গেলেই নবীজির কথা মনে পড়ে। তিনি কি বিবিগনের সাথে কখনো কঠোর ব্যবহার করেছেন? আমি তাঁর উম্মত। তাকে অনুসরণ করা আমার উপর ফরয। আমি কীভাবে তার উম্মত হয়ে বিবির সাথে রূঢ় আচরণ করতে পারি?
.
মসজিদের অদূরে একটা কালভার্ট আছে। সেটার নিচ দিয়ে তিরতির করে পানি বয়ে যাচ্ছে। খোকা খোকা মাছ নাচতে নাচতে ¯্রােতের কোলে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। দু‘জন পা ঝুলিয়ে কিনারায় বসে বসে পোনাপুনিগুলোর খুনসুটি দেখছি। ভাবী ফোন করলেন। কী ব্যাপার?
-আমি সাইকেল চালিয়ে মাদরাসা থেকে ফিরি। ভীষণ গরম পড়ছে। ‘মাইওলা’ বারবার জানতে চাচ্ছে, ঘেমে গেছি কি না। মাদরাসা থেকে ফিরে গোসল করেছি কি না? ফ্রিজ তো নেই, কল থেকে ঠা-া পানি এনে খেয়েছি তো? পকেটে টাকা আছে? দোকান থেকে কিছু এনে খাওয়ার মতো? বড়ভাই কান্নাভাঙা গলায় বলেন,
-জি¦ না, টাকা নেই।
টাকা নেই শুনে দোস্ত ওপারে কেঁদে দিল। তার হাতেও বোধ হয় টাকাপয়সা নেই। থাকলে পাঠানোর ব্যবস্থা করতো। মাসের শুরু তো। গতমাসে পাটি-চাটাই যা বানিয়েছে, সেটা বিক্রি করে, সংসারে লাগিয়ে ফেলেছে। আরও কয়েকটা চাটাই বিক্রির অপেক্ষায় আছে। ছেলেরা বৃহস্পতিবারে মাদরাসা থেকে এলে ‘চালনা’ বাজারে বিক্রি করবে। তখন হাতে দুটো পয়সা আসবে। তখন পর্যন্ত কিছুই করার নেই।
.
গ্রামের মানুষ বিবিকে অনেক সময় আদর করে ‘মাইওলা’ বলে থাকেন। ভাইও কখনো কখনো ভাবীকে মাইওলা বলেন। একদিন বললেন,
-দোস্ত, মাইওলা মানে জানেন তো?
-মাইওলা মানে মেয়েমানুষ।
-সেটা ঠিক আছে। কিন্তু শব্দটার ‘তাহকীক’ শুনে নিন। দোস্তের মতো ‘মাইওলা’-ও দুটি শব্দ দিয়ে গঠিন। মাই মানে ‘ম্যাঁয়- আমি। ওয়ালা-অধিকারী। মাইওলা মানে যে আমার অধিকারী। আমাকে যে অধিকার করে নিয়েছে। আমার দোস্ত সত্যি সত্যি আমার ‘মাইওলা’। বিয়ের পর যত দিন গড়িয়েছে, ততই তিনি আমাকে অধিকার করে গেছেন। একসময় দেখা গেছে আমি আর আমি নেই। আমি আমার ‘দোস্ত’ হয়ে গেছি। প্রকৃত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এমন হওয়া উচিত বলে মনে করি। একে অপরের পরিপূরক। এটা আমার কথা নয়। আল্লাহর কথা,
هُنَّ لِبَاس لَّكُمۡ وَأَنتُمۡ لِبَاس لَّهُنَّۗ
তারা তোমাদের পোষাক, তোমরাও তাদের পোশাক (বাকারা ১৮৭)।
.
ভাই ফোন রেখে আমার দিকে ফিরে বললেন, এভাবে মহব্বত দেখালে, কেমন লাগে বলুন দেখি। বিয়ের আগে আব্বার উপর মনে কষ্ট ছিল। প্রথম প্রথম ভাবতাম, আম্মু যেখানে বিয়ে ঠিক করে গিয়েছিলেন, সেখানে বিয়ে হলেই বোধ হয় ভালো হত। জীবনটা সুখের হত। ভুলটা ভাঙতে দেরি হয়নি। আব্বার জন্য এখন মনখুলে দোয়া আসে। গল্পের গন্ধ পেয়ে কৌতুহলী মন খলবল করে উঠল,
-কোথায় বিয়ে হওয়ার কথা ছিল?
-আমার ছোটখালার মেয়ের সাথে।
-কেন হল না বিয়েটা?
-সে অনেক লম্বা কাহিনী। মাগরিবের সময় হয়ে গেছে। পরে আরেকদিন সময় করে বলবখন।
.
বড়ভাইয়ের সাথে গ্রামের আর দশটি শিশুর মাঝে খুব একটা পার্থক্য নেই। মাদরাসা ছুটি থাকলে, পুরোদস্তুর গ্রাম্যকিশোর বনে যান। বর্ষা এলে, শিশুদের সাথে মিলে পুকুরে দাপাদাপি করেন। পুকুর পাড়ে কয়েকটা ঝুঁকেপড়া গাছ আছে। সেটা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এপার-ওপার সাঁতরান। ছোটদের সাথে প্রতিযোগিতা করেন। ডুবসাঁতার দিয়ে মাছ ধরেন। পাশের বাড়ি থেকে জাল এনে মাছ ধরেন। সেই মাছ পুকুরপাড়ে চুলা কেটে রান্না করেন। ‘জোলাভাতির’ মাছতরকারি খাওয়ার জন্য বাড়ির মেয়েরাও বাটি পাঠিয়ে দেয়। মাছের পেটে ডিম থাকলে, সেটাকে ছেড়ে দিতেন। ডিমঅলা মাছ ধরতে চাইতেন না। ক্বচিৎ ধরলে, লাল-লাল ডিমের ঝোল যা রাঁধতেন না, আহা অমৃত অমৃত!
.
বড়ভাই ‘জাতে যেমনই হোন, তালে পুরোপুরি ঠিক। যতই হাসিফুর্তি করে মাছ ধরেন, শরীকানার পুকুরের মাছ খাওয়ার আগেই, হিশেব করে দাম পরিশোধ করার চেষ্টা চালান। মালিকপক্ষ আধহাত লম্বা জিভ করে ‘তৌবাস্তাগফেরোল্লাহ’ বলতে বলতে পিছু হটেন। তারা পিছু হটলেও, ভাই হটার বান্দাই নন, তিনি পকেটের টাকা খরচ করে, মাছের পোনা ছাড়েন পুকুরে। বাজার থেকে মাছের খাবার এনে ছাড়েন। প্রতিদিন কিছু সময় মাছের সাথে কাটান। একটাকার মুড়ি কিনে, বিকেলে পুকুরপাড়ে এসে বসেন। জলে মাছপোনা, ডাঙায় মানুষপোনা ভাইকে ঘিরে ধরে। জলেডাঙায় পোনাপুনিদের হুটোপুটি দেখার মতো দৃশ্য হয়। ভাইকে তখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের মতো লাগে। নিজের হাতে মাছের আধার ছিটিয়ে দিচ্ছেন। ছেলেমেয়েদের হাতেও মুুড়ি-মুড়কি তুলে দিচ্ছেন। কচিকাঁচারা যেন সাতরাজার ধন হাতে পেয়েছে। মাছেরাও ভাইকে চিনে গিয়েছে। তিনি পুকুর পাড়ে গেলেই মাছেরা ছলবল করে ছুটে আসে।
.
বৃষ্টির দিন হলে, রাতজেগে চলে ডালাশিকার। বড়ভাইয়ের কাছে কয়েক প্রকারের ‘কোঁচ’ জমা আছে। মসজিদের অদূরে ছোট্ট কালভার্ট। বৃষ্টির পানি সোঁ সোঁ করে তীরবেগে ছোটে। বানের পানিতে বড় বড় মাছ নাচতে নাচতে জলার পানিতে মুক্তপ্রাণে বেড়াতে যাওয়ার পথে, কোঁচবিদ্ধ হয়ে শাহাদাত বরণ করে। মাছধরা শেষ হলে শুরু হয় ভাগবাঁটোয়ারা। কেউ কাঁচামাছ নিতে চাইত না। বাড়ির বধূরা চাইত, বড়ভাইয়ের হাতের রান্না খেতে। তাদের কথা একটাই, হুজুরকে আমরা প্রতিদিন রেঁধে খাওয়াই, হুজুর আজ আমাদেরকে রেঁধে খাওয়াবেন। বড় এক হাঁড়িতে মাছরান্না চড়ে। ভাই, রান্না চড়িয়ে দিতে তাহাজ্জুদ পড়তে চলে যান। শাগরেদদের নিয়ে যিকির শেষ করে, আবার রান্না দেখতে আসেন। ততক্ষণে মাছের মনকাড়া সুুুুবাসে চারপাশ মুখরিত। ঘরে ঘরে সাজসাজরব। আজ মসজিদে মাছরান্না হচ্ছে। সবার ভাগে কিছু না কিছু পড়বে।
.
তালের দিন এলে, রাতগুলো হয় বেশ উপভোগ্য। মসজিদের মালিকানায় বেশক’টা তালগাছ। ভাই রাতজেগে তাল পাহারা দেন। দুম করে তালপড়ার শব্দ হলেই, ছোট্টশিশুর মতো দৌড়ে যান। আরও অনেকে ছুটে আসে। কে কার আগে যেতে পারে, তীব্র প্রতিযোগিতা চলে। ফজরের পর মক্তবে কেউ পড়া ভালো করে শোনাতে পারলে, ভাগে জোটে একটা সুপক্ক নধর টসটসে তাল। তালের দিনে, খোকা-খুকুদের পড়ালেখার জোশ বেড়ে যায়। পড়া ভাল পারলেই যে ভাগে তাল পড়বে! পড়া না পারলে পিঠে ‘তাল’ পড়ার আশংকাও থাকে অবশ্য। মৌসুম শেষে দেখা যেত, প্রায় প্রতিটি খোকাখুকুর ভাগেই কমপক্ষে একটা করে তাল পড়েছে। ভাই কৌশলে সবাইকে একদিন করে পাস করাতেন। কোনও ঘরে কয়েকজন থাকলে, তাদের ভাগে একটাই জোটে।
.
স্কুল বা মাদরাসা ছুটি থাকলে, নানারকমের খেলার আয়োজন করেন। প্রায় সব খেলাতেই বড় ভাই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। একেবারে ছোটশিশুর মতো হয়ে যান। পুকুরে সাঁতার প্রতিযোগিতা করেন। দুরন্ত কিশোরের মতো হেলেপড়া আমগাছ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুবসাঁতার দেন। কয়েকটা নৌকা বানিয়ে মসজিদের পুকুরে ভাসিয়ে রেখেছেন। প্রতি জুমাবারে নৌকাবাইচ করেন। নিজেও একটি ডিঙ্গিতে লগি নিয়ে উত্তেজনাময় ভঙ্গিতে প্রতিযোগিতায় নামেন।
.
ভাইয়ের ছাত্ররা বড় হয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন মাদরাসায় পড়াশোনা করছে। কেউ কেউ শিক্ষকতাও করছে। মাদরাসা ছুটি হলে, সবাই বাড়ি ফেরে। প্রায় সকলেই প্রথমে বাড়ি না গিয়ে, তাদের হুজুরের সাথে দেখা করে। যেন তারা বাড়িতে আসেনি। এসেছে হুজুরের সাথে দেখা করতে। হুজুরের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে। পড়াশোনার উন্নতি-অগ্রগতির কথা বলে। নতুন কী শিখেছে, সংক্ষেপে তার বিবরণ পেশ করে। তারপর বাড়িমুখো হয়।
.
দুপুরে-রাতে খাওয়ার সময়, সবাই যে যার বাড়ি থেকে ভাত-তরকারি নিয়ে আসে। সবাই মিলে এলাহি ভোজ হয়। বিরাট দস্তরখানা পড়ে। বড় বড় প্লেট আছে। লঙ্গরখানা বসে যায়। কখনো আরবের মতো পরিস্কার প্লাস্টিকের সুফরা (দস্তরখানায়) সবার ভাত-তরকারি ঢেলে দেয়া হয়। তারপর হয় একযোগে হামলা। সে এক দেখার মতো দৃশ্যই বটে। স্তূপীকৃত রাশিরাশি ভাতের পাহাড় মুহূর্তের মধ্যে নেই হয়ে যাচ্ছে।
.
রাতে শোয়ার সময়, সবাই একটা করে বালিশ নিয়ে হাজির। এলোপাথারি বালিশের পর বালিশ। এস্তেমার মাঠের মতো সারি সারি মাথা আর পা। শুয়ে শুয়ে কখনো কুরআনের আলোচনা, কখনো হাদীসের, কখনো ফিকহের, কখনো উসূলে ফিকহের, কখনো আকীদার, কখনো বিশ^পরিস্থিতির। ছোট্ট কুটিরে খাঁতাখাঁতি যাঁতাযাঁতি করে শুলেও, আরামের সুখনিদ্রা যেতে কারও বিন্দুমাত্র কসরৎ করতে হয় না।
.
ঘুমুতে যত দেরিই হোক, তাহাজ্জুদের সময় হলে, সবাই মিলে নামায, যিকিরে মশগুল হয়ে পড়ে। তারপর মনপ্রাণ উজাড় করে আল্লাহর দরবারে রোনাজারি (কান্নাকাটি)। বড়ভাই দু‘আ করেন। ছাত্রশিষ্যরা কান্নাভেজা আমীন বলে। এসব দিনে এলাকার ময়-মুরুব্বীও কেউ কেউ শেষরাতের ইজতিমায়ী আমলে জুড়েন। বাড়ির মা-বোনেরা খাস দোয়া চেয়ে সনির্বন্ধ অনুরোধ পাঠান। ফজরের পর ব্যয়াম, সাঁতার, সাইকেল, দৌড়। একসময় একটা। মওসুম বুঝে আয়োজন মাদরাসার তালিবে ইলমদের বাড়ির সময়টুকু পুরোই অর্থময় হয়ে ওঠে।
.
মাগরিবের পর বসে বিশেষ মজলিস। সবাই মাদরাসায় কোনও মাসয়ালা না বুঝতে পারলে, প্রশ্নটা খাতায় লিখে রেখে দেয়। বাড়ি এসে, সব প্রশ্নের উত্তর বড়ভাইয়ের কাছ থেকে জেনে নেয়। ভাই প্রথমে নিজে উত্তর দেন না। উপরের জামাতের কাউকে উত্তর দিতে বলেন। না পারলে নিজে বলে দেন। শুরু থেকে দাওরা হাদীস পর্যন্ত প্রতিটি কিতাব, ভাইয়ের প্রায় মুখস্থই বলা যায়। অনেক বছর পড়াতে পড়াতে, সব কিতাব একেবারে আয়নার মতো হয়ে গেছে। সমাধান দিতে খুব একটা বেগ পেতে হয়েছে।
.
সবাই বাড়ি এলে, আরেকটা কাজ করেন। কিতাবী সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে, পালাক্রমে একদিন একজনের বাড়িতে মাহফিলের আয়োজন করেন। সবাই সবার বাড়িতে, চার-পাঁচ মিনিট করে বয়ান করে। পর্দার ওপাশে মা-বোনেরা থাকেন। বেশ ফায়েদা হয় এই আয়োজনে। মা-বোনেরা প্রশ্ন করারও সুযোগ পান। নিজের ছেলেকে দিয়ে, নিজের ভাই বা স্বামীকে দিয়ে প্রশ্ন পাঠানোর নিয়ম। বড়ভাই সাধ্যমতো উত্তর দেন।
.
সবচেয়ে আকর্ষণীয় হয়, হামদ-নাত ও ইসলামী সংগীতের আয়োজনটা। প্রতি ছুটিতে একটা গযলের জলসা হয়। মহিলারা বাড়িতে বসেই যাতে শুনতে পারে, সেজন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকে। একদিন সম্মিলিতভাবে ওয়াজের ব্যবস্থাও থাকে। ওয়াজের চেয়ে সংগীতের দিকেই সবার ঝোঁক বেশি। সেদিন হিন্দু নারী-পুরুষও ভীড় জমায়। তালিবে ইলমরা যে যার মাদরাসা থেকে সুন্দর সুন্দর হামদ-না‘ত শিখে আসে। কেউ কেউ স্বরচিত ইসলামী সংগীতও পরিবেশন করে। আশেপাশের প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্ররাও পরিবেশনের সুযোগ পায়। কেরাত প্রতিযোগিতাও হয়। স্কুলের ছেলেদের জন্য ক্বেরাত প্রতিযোগিতায় আকর্ষণীয় পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকে।
.
ভাই গ্রাম আর মসজিদ ছেড়ে কোথাও যেতেই চান না। একমাত্র ভাবীর কাছেই যান। বাকি সময়ের পুরোটাই মসজিদ আর এলাকার ফিকিরে কাটে। সবসময় বলেন,
‘আল্লাহ আমাকে কত সুখ দিয়েছেন। গ্রামে ছোট ছোট কিতাব পড়াই। শহরে যেতে বলেছিল। ভাল লাগে না। গ্রামে নিরিবিলিতে থাকতে ভাল লাগে।’
.
প্রতি ছুটিতে বড়ভাই গ্রামের পুকুরগুলোতে মাছ জিয়োতে দেন। পুকুর পাড়ে ফল-ফলাদির গাছ লাগান। গ্রামের রাস্তার দু’পাশে গাছ লাগান। ছাত্রদের নিয়ে সেসবের পরিচর্যা করেন নিয়মিত। ঢাকায় যারা পড়ে, তাদেরকে বলে দেন, নতুন কোনও গাছ পেলে নিয়ে আসতে। গ্রামজুড়ে নানা ঔষধি গাছের ছড়াছড়ি। প্রায় সব ধরনের ফল গাছ আছে। প্রতি বাড়ির পুকুর পাড়ে দশ-এগার প্রকারের ফলগাছ। অনেক ফলগাছ এমন আছে, আশেপাশের গ্রামের মানুষ জীবনে চোখেও দেখেনি। এই গ্রামের দেখাদেখি অন্য গ্রামেও ফলফলাদির চাষবাষ বেড়ে গেছে। মাছচাষেও জোয়ার এসেছে। ভাইয়ের বরকতময় ছোঁয়ায়, গ্রামটা ফল-শষ্যে, মাছ-তরকারিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে।
.
বড়ভাইয়ের বইকিতাব সংগ্রহ করার বাতিক আছে। নেশা বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত। ছাত্ররা বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বিদেশে আছে। সবার কাছে বইকিতাব চেয়ে নেন। যাদের বইসংগ্রহের নেশা থাকে, তারা সাধারণত বই হাতছাড়া করতে চান না। চাইলেই দিয়ে দেন। কেউ ফেরত দেয়, কেউ দেয় না। সমস্যা নেই, আবার সংগ্রহ করে নেন। তার কথা হল, আমি তো বইটা একবার পড়ে নিয়েছি। এবার অন্যরা পড়–ক। সকালের মক্তবে ছেলেরা পড়তে এলে, তালিকা ধরে ধরে প্রত্যেক ছাত্রকে একটা বই দেন। একসপ্তাহ পরে বইটা ফেরত নিয়ে নেন। বইয়ের জন্য আলাদা হাজিরাখাতা বানিয়েছেন। এমন করে বানানো, নামের পাশে বইয়ের নাম লেখা যায়। জানতে চাইলাম,
-এভাবে বই দিলে কেউ পড়ে?
-আমার কাজ হল চেষ্টা করা। ছাত্রদেরও উদ্ব্দ্ধু করি তারা যেন তাদের মাকে-বোনকে বইটা পড়তে বলে। আশেপাশের প্রায় সবাই আমর ছাত্র বা ছাত্রী। বেশ আর কম সবারই অক্ষরজ্ঞান আছে। একদম বৃথাও যায় না। কিছু না কিছু তো পড়া হয়ই। তাতেই পরিশ্রম সার্থক।
.
ভাইয়ের একটা কাজ বেশ অবাক করত। তিনি আসরের পরে, কখনো ‘মিনিটমাদরাসা’-এর কার্যক্রম স্থগিত রেখে, গ্রামের সবচেয়ে গরীব গেরস্থদের বাড়িতে হাজির হন। সাথে থাকে ছোটখাট হাদিয়া। হাদিয়া বলতে, হয়তো আধাকেজি চাল, অথবা একপোয়া মসুর ডাল, অথবা এককেজি আলু, কখনো একপোয়া পেঁয়াজ। এধরনের সাংসারিক টুকিটাকি সদাই হাদিয়া হিশেবে নিয়ে যেতেন। এমন অদ্ভুত হাদিয়া দিতে আর কাউকে দেখিনি। গ্রামে যারা ভিক্ষুক আছে, সবার তালিকা ভাইয়ের কাছে আছে। মাসে অন্তত একবার হলেও, তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা করেন। সাথে কিছু হাদিয়া নিয়ে যান। তাদেরক উপায়-উপার্জনের পথ বাতলানোর চেষ্টা করেন। কয়েকজনকে তিনি ভিক্ষবৃত্তি ছেড়ে, নিজের উদ্যোগে স্বাবলম্বী হতে উৎসাহিত করতে পেরেছেন। গরীব গেরস্থ বাছাইয়ে, মুসলিম বা হিন্দুর মাঝে কোনও বাছবিচার করতেন না।
.
মাদরাসার বড় বড় কিতাব পড়ালেও, বড়ভাই প্রতিবছর একেবারে নিচের জামাতে একটা কিতাব চেয়ে নেন। কখনো নূরানীখানায়। কখনো দোয়াযদাহমের উর্দু কায়দা। কখনো ইয়াযদাহমের ফার্সি কী পহেলী। ভাইয়ের চিন্তা পরিস্কার, সবাই বড় বড় কিতাব পড়াতে একপায়ে খাড়া। উপরের কিতাব পড়ানো সহজ। ছোটদের কে পড়াবে? তাদেরকে পড়ানো কি লজ্জার? আমার কাছে মনে হয়, বুখারি-মিশকাত পড়ানোর চেয়ে ‘বাকুরাতুল আদব’ পড়ানো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বেশি কঠিন। উপরের কিতাবে তেমন কোনও মেহনত নেই। চ্যালেঞ্জ নেই। প্রথম এক-দুই বছর হয়তো একটু মুতালা‘আ করতে হয়, পরে আর খুব বেশি একটা মুতালা‘আর প্রয়োজন হয় না। উপরের জামাতে ‘দরস’ করা আর নিচের জামাতে দরস করার সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে, উপরের জামাতে শুধুই পড়ানো। একটা সবক গড়গড় করে উগরে দিয়ে চলে আসা। কিন্তু নিচের জামাতে গড়গড় করে উগরে দিয়ে আসার কিছু নেই। ছোটদের সামনে বসলে, সারাক্ষণ তটস্থ থাকতে হয়। প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকতে হয়। একচোখ কিতাবে রাখলে, আরেক চোখ ছাত্রদের দিকে রাখতে হয়। পড়া ধরছে কি না, পড়া বুঝতে পারছে কি না, ছাত্রের চেহারা দেখে আঁচ করে নিতে হয়। সেমতে ব্যবস্থা নিতে হয়। প্রতিনিয়ত তৎপর থাকতে হয়। একটু বেখেয়াল হলেই দেখা যাবে, দুষ্ট-অমনোযোগী তালিবে ইলম কিতাব ছেড়ে অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যোগ্য ওস্তাদগনকে উপরের কিতাব দেয়া হয়। তাদেরকে উপরের পাশাপাশি নিচের কিতাবও দেয়া উচিত। তারা পড়িয়ে পড়িয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো দরকার নয়?
.
ভাইয়ের মতো এমন ওস্তাদভক্ত ছাত্র আর দেখিনি। কথায় কথায় ওস্তাদের কথা বলেন। ওস্তাদের জন্য দোয়া করেন। ওস্তাদগনের কথা বলতে গেলে তার চোখে পানি চলে আসে। ভাইয়ের সাথে কথা বলতে বসলে, মোটাদাগে তিনটি বিষয় ঘুরেফিরে আসে,
১: আল্লাহর কথা। কুরআনের কথা। তাফসীরে জালালাইন, তাফসীরে বয়যাবী, তাফসীরে জাওয়াহিরুল কুরআন। তাফসীরে কুরতুবী আর তাফসীরে মা‘আরিফুল কুরআনও তার হাতের নাগালে থাকে। যখন তখন তাফসীরে কুরতুবী খুলে বসেন।
২: নবীজি সা.-এর কথা। মেশকাত শরীফের সুত্র ধরে। ফাঁকে ফাঁকে আসে ওস্তাদগনের কথা।
৩: ভাবীর কথা। এই প্রসঙ্গ উঠলেই, ভাবীর কোনও-না-কোনও ঘটনা বলবেনই। বিবিকে ভালোবাসা মানেই তো আল্লাহকে ভালোবাসা। আল্লাহর রাসূলকে ভালোবাসা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল না বললে কি আমি বিবিকে ভালোবাসতাম? এই একটা মানুষের ভালোবাসার মাধ্যমে আমি আল্লাহ ও রাসূলকে আরও বেশি ভালোবাসার প্রেরণা পাই। যতবার বিবির সাথে কথা বলি, আল্লাহর প্রতি মনটা আরও বেশি শোকরগুজার হয়ে ওঠে। ইমাম বুখারী রহ. প্রতিটি হাদীস লেখার আগে ওজু-গোসল করে দুই রাকাত নামায পড়ে নিতেন। আমারও প্রতিবার ‘জানের দোস্তের’ সাথে কথা বলার পর, দুই রাকাত সলাতুশ শোকর আদায় করতে ইচ্ছে করে। সময় থাকলেও আদায় করিও।
.
আচ্ছা, এই তাহলে ঘটনা। তাইতো বলি, ফোন রেখেই কেন নামাজে দাঁড়ানো হয়? এখন তো কোনও নামায নেই? ভাই বলেন, আমার দোস্তের মতো এত দামী আর বড় নেয়ামত পাওয়ার যোগ্য আমি নই। করুণাময় অশেষ দয়া করে, নেয়ামত দিয়েছেন। আমি যদি শোকর আদায় না করি, নেয়ামতের না-শোকরি হয়ে যাবে না,
لَىِٕن شَكَرۡتُمۡ لَأَزِیدَنَّكُمۡۖ وَلَىِٕن كَفَرۡتُمۡ إِنَّ عَذَابِی لَشَدِید
তোমরা যদি সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা আদায় করো, আমি তোমাদেরকে আরও বেশি দেব, আর যদি অকৃতজ্ঞতা কর, তবে জেনে রেখ, আমার শাস্তি অতি কঠিন (ইবরাহীম ৭)।
.
আমার ‘হাকীকী দোস্ত’ আমার জীবনে আসার পর থেকে, আমি শুধু বরকত আর বরকত দেখতে পাচ্ছি। সবচেয়ে বড় কথা, আমার চিন্তার গুনাহ একেবারে নেই হয়ে গেছে বললে, আশা করি ভুল বলা হবে না। একটু কথা বললেই ভাইয়ের মুখে মেশকাত শরীফের হাদীস চলে আসে। এখন বলে উঠলেন, বিয়ে হল গুনাহের এন্টি ভাইরাস।
يا مَعْشَرَ الشَّبابِ، مَنِ اسْتَطاعَ الباءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، فإنَّه أغَضُّ لِلْبَصَرِ وأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ،
হে যুবক সম্প্রদায়, তোমাদের যাদের মধ্যে বিবির ভরণপোষণের সামর্থ আছে, তারা শিঘ্রি বিয়ে করে ফেলো। কারণ বিয়ে তোমাদের দৃষ্টিকে পাপদিক থেকে র্বাঁচিয়ে রাখবে। লজ্জাস্থানকে গুনাহ থেকে হেফাযত করবে (বুখারী শরীফ ১৯০৫)।
.
পেয়ারা নবীজি সা. এই হাদীসে উম্মতের যুবকশ্রেণীকে বিয়ের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। যার বিয়ের সামর্থ আছে, সে বিয়ে না করলে, তার দ্বীন অপূর্ণ থেকে যায়। বিয়ে মানবজীবনের পূর্ণতার প্রতীক। বিয়ে মানবপ্রকৃতির স্বাভাবকি চাহিদা। পানাহার যেমন প্রাণীর জৈবিক চাহিদা, বিবাহও তেমিন। শরীয়ত মানুষকে যেমন আল্লাহর ইবাদত করতে বলে, তদ্রƒপ বিয়েও করতে হবে। বিয়ের মাধ্যমে আল্লাহর অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়।
.
ভাইকে আলাভোলা মনে হলেও, ভাই তাকওয়ার ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন থাকেন। প্রকৃত মুমিন এমনি হয়ে থাকেন। ভাই বলেন,
‘এখানে যখন প্রথম প্রথম জায়গীর থাকতে আসি, তখন টগবগে তরুণ। বিয়ে হয়েছে আরও পরে। কিছুদিন পর বিয়ে হল। নতুন বিয়ে হলেও বিবির সাথে ‘আশনাই’ তখনো জমাটি ‘খুশবাই’ ছড়াতে শুরু করেনি। গুনাহের নানা উপকরণ চারপাশে মজুত। এখনকার মতো ফোন ছিল না যে, চুটিয়ে চুরিয়ে বিবির সাথে রাত-বিরেতে প্রেম করব। আল্লাহ হেফাযত করেছেন। বিপদ এখনো পুরোপুরি কাটেনি। এখনো ছাত্রীরা বাপের বাড়ি এলে, আমার সাথে কথা বলার জন্য ‘হুজরায়’ চলে আসে। আমি একা বসে আছি। পানিপড়া নেয়ার ছুতোয় হুট করে হুজরায় ঢুকে পড়েছে, এমন ঘটনা অনেকবার ঘটেছে। মারমুখো ভঙ্গিতে জানতে চাই,
-কেন এসেছিস?
-পানি পড়া আর বাবুর জন্য দোয়া নিতে।
-এসবের জন্য তোকে আসতে হবে কেন। জামাই বা বাপ-ভাইকে পাঠা।
-আমি আপনার ছাত্রী। ওস্তাদের কাছে আসলে সমস্যা কিসের। আপনার কিছু লাগবে কি না, দেখতে এসেছি।
-আর কী লাগবে না লাগবে, সেটা ঘরে বসে ভাববি। এখানে আসার দরকার কী। আর এখন বিয়ে হয়েছে। স্বামীর কী লাগে না লাগে, সেদিকে খেয়াল রাখ। স্বামীর খেদমত করে তার দোয়া নে। দোয়ার জন্য আমার কাছে আসতে হবে না। ঘরে বাবা-মা আছেন। জামাইর বাড়িতে জামাই আছে, শ^শুর-শাশুড়ী আছেন। তারা তোর জন্য দোয়ার ভা-ার।
.
ভাই হুজরার দরজা-জানালা চব্বিশ ঘণ্টা হাটপাট করে খোলা রাখেন। এখন বুঝতে পারলাম কেন এটা করেন। পাশেই রাস্তা। সবসময় কেউ না কেউ আসছে-যাচ্ছে। যেতে আসতে হুজরার অন্ধকার কোণ পর্যন্ত পথিকের নজরে পড়ছে। লুকোছাপার কিছু নেই। ভাইয়ের কাছে যাওয়ার পর এভাবে খোলা দরবারে বসে থাকতে একটু লজ্জা লজ্জা লাগত। পরে অভ্যেস হয়ে গেছে। ভাই তো আরও খোলামেলা। উদোম গায়ে রোমশ শরীরে বিকট স্বরে নাক ডেকে গররর করে ঘুমুচ্ছেন। কোনও বিকার নেই। যস্মিন দেশে যদাচার। আমিও ভাইয়ের অনুকরণে একেবারে ‘একশতে একশ’ হয়ে বসে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।
.
ভাইয়ের দরজার তালাও নেই। তালার কী প্রয়োজন? চোরের হাত থেকে বাঁচার জন্য? চোর এখানে এসে কী পাবে? দামী বলতে একতাক কিতাব। মাদরাসায় যাওয়ার সময়ও দরজাটা একটু ভেজিয়ে দিয়ে চলে যান। বাতাস এসে দরজা আবার খুলে দেয়। পুরোদিন এভাবে থাকে। যাদের স্কুল এগারটার পর, তারা এখানে বসে বসে বাড়ির কাজ করে। মাঠের কাজের ফাঁকে গেরস্তরা হুজরায় এসে পানি খায়। বউরা এখানে খাবার রেখে যায়, জমির কাজ শেষে করে এখানে এসে ভাত খেয়ে যায়। হুজুরের মন যেমন সদা উন্মুক্ত, ঘরের দ্বারও অবারিত। বহুদিন পর এমন একজন মানুষের দেখা পেলাম, যার ঘরে তালার প্রয়োজন হয় না।
.
প্রতি বৃহস্পতিবার জোহরের আগেই ঘণ্টা শেষ হয়ে যায়। ভাইয়ের শেষ ঘণ্টা খালি। মসজিদে এসে যাতে আসর পড়াতে পারেন, সেজন্য এই ব্যবস্থা। বৃহস্পতিবারে ঘণ্টা শেষ করেই সাড়ে এগারটার দিকে ভাই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়েন। মাদরাসার সবাই জানে, তিনি এমন ব্যস্তসমস্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছেন। তাই এই সময়ে কেউ ভাইকে ঘাঁটায় না। কেউ কথা বলতে এলে, ভাই ঝাঁজিয়ে ওঠেন। শিক্ষকদের কেউ দুষ্টুমি করে এটাসেটা বলে ভাইকে বাধা দিয়ে দেরি করিয়ে দিতে চান। কোনও বাধাই ভাইকে আটকে রাখতে পারে না। দুদ্দাড় করে সব ছিঁড়েখুঁড়ে বেরিয়ে আসেন। কখনো রিকশায়। কখনো টমটমে। বেশিরভাগ সময় হেঁটে। এক বৃহস্পতিবারে ভাই সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক জোরাজুরি করলেন। যেতে খুব ইচ্ছেও করছিল। টোনাটুটির মিষ্টি সংসার দেখার লোভ কেইবা সামলাতে পারে? তবুও মনকে কষে বাঁধলাম। ভাইকে নিরামিষ মুখে বললাম,‘কাবাব মে হাড্ডি হতে চাই না’। ভাই ভীষণ খুশি হলেন। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন যেন।
.
বৃহস্পতিবারে শেষ দরসে পড়ানো শেষ করে কিতাব বন্ধ করতে না করতেই বাড়ির ফোন। ওদিকে যেন তর সইছে না। ভাবী জানেন কয়টা বাজে দরস শেষ হবে। ভাই কখন কিতাব বন্ধ করবেন। একেবারে কাঁটায় কাঁটায় কল। ভাবী এই কলটা করার জন্য গত একঘণ্টা ধরে মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছেন,
-হ্যালো, এই তো বেরিয়ে পড়েছি! কী? তাড়াতাড়ি করবো? জি¦ না, দোস্ত আজ যে তাড়াতাড়ি করা সম্ভব নয়! ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করুন। পকেটে যা আছে, তা দিয়ে কোনও রকমে টমটম ভাড়াটা হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি কিভাবে যাই? সিএনজি স্ট্যান্ডে গেলে, সহযাত্রীর অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে।
-দেরি হলে, রিজার্ভ করে চলে আসুন। এখানে এলে আমি ভাড়া দিয়ে দেব।
-এই শুনুন, আজ মনে করে ডিম আর মধু খেয়েছিলেন?
-খেয়েছি বাবা খেয়েছি। আজ সকালে গোসল করে সর্দি লেগে গেছে।
-আচ্ছা, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি পানি গরম দিয়েছি। একসাথে নামাজ পড়ব। পুঁটি মাছের কোপ্তা করেছি। সাথে আছে পেঁয়াজ কুঁচো দিয়ে মরিচ ভর্তা। হাতে আর টাকা ছিল না। জানতাম সিএনজি রিজার্ভ করতে হবে। তাই পুরো সপ্তাহ তরকারি না খেয়ে, টাকা বাঁচিয়েছি। আজ সকাল থেকে বড়শি বেয়ে মাছক‘টা ধরতে পেরেছি। গাছে মরিচ যা ছিল, সব তুলে এনেছি।
- আম্মা ঘরে আছেন না?
-আম্মু আজ বড় আপুর বাড়ি গিয়েছেন।
-মাঈশা?
-তাকেও তার দাদুর সাথে ফুফির বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। ঘর পুরোই খালি। তাড়াতাড়ি এসে পড়–ন।
ভাই ভীষণ আক্ষেপ নিয়ে বলেন,
‘আহা, যদি দু’টি ডানা থাকত!’
-বাড়ি চলে আসতে বলছ?
-আসবেন?
-মন চাইছে উড়ে যাই। কিন্তু আজ সম্ভব নয়। এককাজ করলে কেমন হয়? তুমি ওখান থেকে বাতাস কর।
-কোথায় বাতাস করব?
-নিজেকেই? আমি এখানে পাঞ্জাবী কুলে আদুল গায়ে বসি। দেখবে, তোমার পাখার বাতাস এতদূরে এসেও আমাকে শীতল করে দেবে।
-আপনি মাঝেমাধ্যে এমন এমন কথা বলেন! ঠিক আছে। বাতাস করা শুরু করেছি।
ভাই সত্যি সত্যি জামা খুলে ফেললেন। ফোনে আহ! আহ করতে লাগলেন। আচ্ছা রেহানা, আমি উদোম হয়ে বাতাস খাচ্ছি। আহ সব শীত হয়ে গেল রে! এবার ঠা-া লেগে গেল বুঝি, হ্যাঁচ্চো!
এই বুড়ো বয়েসেও এত প্রেম কোত্থেকে যে আসে! ভাইয়ের দাড়ি প্রায় সবই শাদা হয়ে গেছে। মাথার চুলগুলো অবশ্য আধপাকা।
.
সতের বছর মেশকাত আউয়াল পড়িয়েছেন। বয়যাবি শরীফ পড়ান কয়েক বছর ধরে। প্রথম বছর, সবক বণ্টন করার দিন, কথা উঠল বড়ভাই ছাত্রজীবনে বয়যাবি শরীফ পড়েননি। নাজেম সাহেব ডেকে পাঠালেন,
-হুজুর, শুনলাম আপনি বয়যাবি পড়েননি, এখন পড়াবেন কী করে?
-হুজুর, বয়যাবি শরীফের মুসান্নিফ, নিজে না পড়ে যদি, বয়জাবি লিখতে পারেন, আমি কেন পড়াতে পারব না?
এরপর আর কথা চলে না। বৃক্ষ তোমার নাম কী? নাম দিয়ে কী হবে, ফলে পরিচয়। সুযোগসন্ধানীরা শতচেষ্টা করেও খুঁত ধরতে পারল না। অবাক করা ব্যাপার, ভাইয়ের মতো এমন ফিরিশতাস্বভাব মানুষেরও শত্রু থাকে? কেন নবীজি সা.-এর শত্তুর ছিল না? ছাত্ররাও ভাইয়ের কাছে বয়যাবি পড়তে পেরে খুশি। শুধু পড়ান তো না, রীতিমতো গুলে খাইয়ে দেন।
.
বড়ভাই কথায় কথায় তার শায়খের উক্তি বলেন। ফজরের পর হাঁটতে বের হয়েছি। ভাই তার শায়খের কথা বললেন,
আল্লাহকে পাওয়ার তিনটি উপায়,
ক: সোহবতে আহলুল্লাহ। আল্লাহঅলাদের সাহচর্য।
খ: তাফাক্কুর ফী খালকিল্লাহ। আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা।
গ: কাসরতে যিকরুল্লাহ। বেশি বেশি আল্লাহর যিকির।
আমি আরেকটা ধারা যোগ করি,
ঘ: জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ।
.
দু’জন বের হয়েছি। হাঁটতে হাঁটতে বৃষ্টি এল। বেশিদূর যাওয়া হল না। দৌড়ে মসজিদে ফিরলাম। প্রতিটি ঘটনায় ভাইয়ের মন্তব্য থাকে। বৃষ্টি দেখে তার শায়খের কথা বললেন,
‘আকাশ হল স্বামী। যমীন হল স্ত্রী। বৃষ্টি হল ‘বীর্য’। বৃষ্টির মাধ্যমে যমীনের সন্তান হয়। মানুষের সন্তান একরকম হয়। একধরনের নয়। আকাশের বীর্যে অসংখ্য সৃষ্টির বীজ লুকিয়ে থাকে। যমীনের ডিম্বাশয়েও অগণিত প্রাণীর উৎস বিদ্যমান থাকে। এক বৃষ্টি দিয়ে হাজারো প্রাণ সৃষ্টি হয়। এক উদরে লাখো প্রাণীর জন্ম হয়।’
আল্লাহঅলাদের দৃষ্টিই আলাদা। তারা সবসময় আল্লাহর চিন্তায় বিভোর থাকেন। আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে ভাবনার অতলে ডুবে থাকেন। ডুবে ডুবে সৃষ্টিরহস্য নিয়ে মজে থাকেন। ভাইও, যেখানে যা দেখেন, সবকিছুতে কীভাবে যেন রাব্বে কারীমের ‘কুদরত’ আবিষ্কার করে ফেলেন। সবকিছুতো আল্লাহপাকেরই তৈরি। কিন্তু সেটাকে গ্রহণযোগ্য বক্তব্যে প্রকাশ করতে পারেন ক’জন?
.
রাস্তায় বের হলে ভাই একনাগাড়ে সালাম দিয়েই যান। ছেলেবুড়ো, শিশু-কিশোর সবাইকে। কোনও বাছবিচার ছাড়াই। নাম ধরে হাল-কুশল জানতে চান। গ্রামের সবার নাম জানেন। সবাই তাঁর দোস্ত। যাকেই দেখেন,
-কী দোস্ত, কী খবর?
বিবিকে ফোন করেও সালাম দিয়ে বলেন,
-দোস্ত কী খবর?
প্রথম প্রথম শুনতে বেশ অবাক লাগে। কারও কারও হাসিও পায়। বিবিকে দোস্ত ডাকছেন যে? ভাইয়ের সরল উত্তর,
-বিবির চেয়ে বড় দোস্ত আর কে আছে? বিবির সাথে দোস্তি করা ফরয। বিবির সাথে দোস্তি না করলে, আল্লাহর নারাজ হন। আল্লাহর রাসূল সা. নারাজ হন। সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম বিবির সাথে দোস্তি করে গেছেন। আমাদের পেয়ারা নবীজি আম্মাজানদের সাথে দোস্তির জীবন কাটিয়ে গেছেন। তাদের সাথে দোস্তে মতো হাসিগল্প করেছেন। খেলাধূলা করেছেন। বিবির সাথে দোস্তির যে মজা, অন্য কারও সাথে দোস্তিতে কি সেই মজা আছে? বিবি হলেন হালাল দোস্ত। তার সাথে সবকিছু করা হালাল। দোস্ত শব্দটা এসেছে ফার্সি থেকে। ‘দো’-দুই আর ‘আস্ত’-অস্তিত্ব থেকে। মানে দুই অস্তিত্ব একসাথ হওয়াকে দোস্তি বলে। আমাকে বলুন তো দোস্তরা, বিবি ছাড়া আর কোন দোস্তির মধ্যে ‘দুই অস্তিত্ব’ এক হয়?
.
ভাইয়ের কাছে টাকা থাকে না। ফোনেও ব্যালান্স থাকে না। সবার খোঁজ-খবর করতে করতে, কোন ফাঁকে টাকা ফুরিয়ে যায়, টেরও পান না। প্রতিবেশির খোঁজ রাখা কুরআনি দায়িত্ব। সশরীরে গিয়ে দেখা করা সম্ভব নয়, অন্তত ফোনে হলেও দু’চার কথা বলে, কুরআনি আমল জারি রাখেন। ভাবী বুধবারে ফোন করলেন। বাড়ি যাওয়া দরকার,
-আমার কাছে ভাড়ার টাকা নেই। শুক্রবারে জুমা আছে। এখন কীভাবে আসি!
-আপনি আসুন। আমি ভাড়ার টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ফোনে কথা শেষ করে, ভাই লাজুক হেসে বলেন,
-বুড়ো হয়ে গেছি, এখন ঘন ঘন বাড়ি গিয়ে কাজ কী? তা না, প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যাওয়ার আবদার জুড়বে। না গিয়েও পারি না। শুক্রবারে ধেয়ে ধেয়ে এসে কোনওমতে জুমা ধরতে হয়। এই তো ক’দিন আগে বাড়ি গেলাম। তারপরও বাড়ি গেলে এমনভাবে গ্রহণ করে, যেন বহুদিন পর বাড়ি এসেছি। শুক্রবারে জায়গীর বাড়িতে ফেরার সময়, কিছু না কিছু বানিয়ে দেবেই। আজ কত বছর হয়ে গেল, কখনো এর ব্যতিক্রম হয়নি। বিদায় দেয়ার সময়, এখনো সেই প্রথম দিকের মতোই মনখারাপ করা ভঙ্গিতে বিদায় জানায়। যেন চিরদিনের জন্য দেশান্তরে যাচ্ছি। আর কখনো ফিরব না। পইপই করে বলে দেয়, আগামী বৃহস্পতিবারে যেন, জোহরের আগে ঘণ্টা শেষ করেই বাড়িতে চলে যাই। সকালে মাদরাসায় যাওয়ার সময়ই যেন, জায়গীর বাড়িতে বলে যাই। সপ্তাহে একটা দিন একসাথে থাকি। যতটা সম্ভব সময়টা বাড়িয়ে নিতে চায়। বৃহস্পতিবারে দিনে দিনে গেলে, দু’জন কিছুটা সময় বেশি পেলাম। আগে শুক্রবারে আসার সময় আলাদা করে দুই ভাড়ার টাকা দিয়ে দিত। সেদিনের ফেরার ভাড়া আর পরের সপ্তাহে বাড়ি যাওয়ার ভাড়া। প্রতি সপ্তাহ শেষেই দেখা যেত, ভাড়ার টাকা নেই। ভাবী আবার নতুন করে পাঠান।
.
ভাইয়ের কথাটা শুনে চমকে উঠলাম। ভাই বললেন,
‘আল্লাহর জন্য আমার শুধু পরান পোড়ে। আল্লাহকে যে কখন দেখব! আল্লাহ আমাকে কতকিছু দিয়েছেন! কত নেয়ামতে ডুবিয়ে রেখেছেন।’
দুপুরে একা একা তাফসীরে বয়যাবীর পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে, গালে হাত দিয়ে ভাবি, আল্লাহর জন্য প্রাণ কাঁদে, এমন অভিনব কথা কীভাবে বলতে পারলেন? এভাবে ভাবতে পারলেনই-বা কীকরে? শুধু মুখের কথা তো নয়, বাস্তবেই তিনি অনুক্ষণ আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকেন। মুখ খুললেই আল্লাহর কথা বের হয়। এভাবে তো কাউকে বলতে শুনিনি। আল্লাহর জন্য প্রাণ কাঁদে? এত সহজে এমন গভীর কথা, কীভাবে ভাই বলতে পারলেন? কথাটা যতই ভাবি, গা-শিউরে ওঠে। আল্লাহর প্রতি মহব্বত কতটা গভীর হলে, এভাবে বলা যায়? রাব্বে কারীমের যিকির কলবে কতটা জাগরূক থাকলে, আল্লাহর জন্য কারও প্রাণ কাঁদতে থাকে? আল্লাহর প্রতি বান্দার ভালোবাসার চূড়ান্ত রূপ কী? আল্লাহর জন্য, আল্লাহর দীদার লাভের জন্য বেচাইন-ব্যাকুল হয়ে ওঠা?
.
বড়ভাই থাকেন মসজিদের লাগোয়া ছোট্ট একটি কুঁড়েঘরে। পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে সোজা ‘দুধগঞ্জ’ বাজারের দিকে। প্রায়ই ভাত খেতে বসার আগে, দরজার গিয়ে দাঁড়ান। কোনও রিকশঅলা দেখলে ডেকে আনেন। জোর করে খেতে বসান। বলেন, মেহমান নেওয়াজি নবীঅলা গুণ। নবীগণ সবাই মেহমান নেওয়াজ ছিলেন। খানা একজনের হলেও, দু’জনে খেতে কোনও সমস্যা নেই। খেতে খেতে বলেন
‘যত হাত তত বরকত।’
গরীব রিকশাঅলা হুজুরের সাথে ভাত খেতে পেয়ে, বর্তে যেত। বাজারে এমন কোনও রিকশাচালক নেই, যে ভাইয়ের সাথে ভাত খেতে বসেনি। শুধু কি রিকশাঅলা? হুদিনে (শুকনোর মওসুমে) ভিনদেশ থেকে মাছ ধরতে আসা পেশাদার জেলেরাও ভাইয়ের দস্তরখানায় ঠাঁই পেত। গ্রীষ্মকালে পুকুরের পানি শুকিয়ে এলে, গেরস্তরা পুকুড়ে বেড় দিয়ে মাছ ধরে ফেলে। সামনে বর্ষা নতুন মাছ ঢুকবে। বর্ষা গেলে নতুন পোনা জিয়োবে। হয়তো পুকুরের পানি সেঁচে, আরেকটু গভীর করবে। ডাক পড়ে জেলেদের। জেলেরা সদলবলে এসে মাছ ধরে দিয়ে যায়। কাজ শেষ হলে পুকুরপাড়ে রান্না চড়ায়। জাল শুকোতে দেয়। আজকের বেড়ে জাল কোথাও ছিঁড়ে গেলে, সেটা ‘তুনে’ (সেলাই করে)।
.
বড়ভাই দুপুরে খেতে বসার আগে ‘মেহমান শিকারে’ বের হন। বের হয়েই দেখলেন, জেলের দল তাদের ‘জালসংসার’ পেতে বসেছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক যে, তাকে ‘শিকার’ করে আনলেন। জেলেবুড়ো অবাক। হুজুর তাকে খেতে ডাকছেন? হুজুরের ঘরে, হুজুরের সাথে বসে একজন জেলে ভাত খাবে? এমন ঘটনা যে আগে কখনো ঘটেনি। কেউ কখনো এভাবে আদর করে ডাকেনি যে! জেলেখুড়ো অভিভূত। হুজুর শুধু পেটই ভরিয়ে দেননি। মনও ভরিয়ে দিয়েছেন। সে হিন্দু জেনেও, অবহেলা করেননি। কত মুসলমানের বাড়িতে এই জীবনে ‘বেড়’ দিয়েছি, কত হুজুরে বাড়িতেও গিয়েছি, কই কেউ তো এভাবে আল্লাহর কথা বলেননি। স্বর্গ-নরকের কথা বলেননি?
হারাধান জেলে ভাইয়ের দোচালা ঘর থেকে বের হতে হতে কী এক ভাবনায় ডুবে গেল। হুজুর তাকে বাড়িতে যাওয়ার দাওয়াতও দিয়েছেন। বাড়ির পুকুরের মাছ ধরতে হবে। সাথে আরতির মাকেও নিয়ে যেতে বলেছেন। এতটা আদর কোনও মুসলমানের কাছে আগে পায়নি।
.
ভাই তিনটা কথা বললে, তারমধ্যে একটা কথা ভাবীকে নিয়ে থাকবেই। এমন ‘মজনুস্বামী’ আর দেখিনি। ভাবীওবা কম যান কিসে। তাঁর ফোনের বহর দেখলে মনে হয়, তার আর কোনও কাজ নেই, একটু পরপর ভাইয়ের সাথে কথা বলাই তার জীবনের একমাত্র ধ্যানজ্ঞানযপ। আসলে ব্যাপারটা এমন নয় মোটেও। ভাবী খুবই বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন এক পরিপূর্ণ নারী। দক্ষ হাতে ঘর-সংসার আগলান। নিপুণ নৈপুণ্যে দশদিক সামলান। দোষের মধ্যে, স্বামীর প্রতি যুক্তিতক্কগপ্পোতীত ‘মহব্বত’।
.
ভাইয়ের দিন শুরু হয় ভাবীকে দিয়ে। শেষও হয় সেখানে। কী এক মোহময় নেশায় যে দু’জনে অহর্নিশি বুঁদ হয়ে থাকেন। তাদের মনোজগতে দু’জন ছাড়া ভিন্ন কেউ আছে বলে মনে হয় না। একে অপরের পরিপূরক। যা করার দু’জন মিলে করেন। যা ভাবার দু’জন মিলে ভাবেন। ভাইয়ের কর্মপরিধির পুরোটা জুড়েই ভাবী থাকেন। ভাবীর পুরোটা জুড়েও ভাই থাকেন।
.
ভাবী ফোন করতে দেরি করলে, ভাই নিজেই অস্থির হয়ে ফোন করেন। একেকবার ফোন করে, অতিজোশের সাথে বলে উঠেন,
صَدَقْتَ يا رَسُوْلَ اللهِ
হে আল্লাহর রাসূল! আপনি সত্য বলেছেন।
প্রথম প্রথম অবাক হয়ে তাকাতাম। একটু পরপর একথা কেন বলেন? একদিন থাকতে না পেরে, ফস করে প্রশ্নটা করেই ফেললাম। ভাইয়ের মুখে নির্মল হাসি। কিছুটা লাজুকও বটে।
-যতবারই দোস্তবিবির সাথে কথা বলি, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়া সাল্লামের একটা হাদীসের কথা মনে পড়ে,
الدُّنيا كلُّها متاعٌ، وخيرُ متاعِ الدنيا المرأةُ الصالحةُ
দুনিয়ার পুরোটা জুড়েই নানা ভোগ-উপভোগের বস্তুর ছড়াছড়ি। সম্পদ-সম্পত্তির জড়াজড়ি। দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম অমূল্য ‘সম্পদ’ হল নেককার ‘বিবি’ (মুসলিম শরীফ ১৪৬৭)।
আমার পেয়ারা নবীজি সাদিক। সত্যবাদী। আমার পেয়ারা নবীজি ‘আমীন’। বিশ^স্ত। আমানতদার। তিনি যা বলে গেছেন তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। আমি যদি ইসলামের অন্য কিছুই না জেনে শুধু নবীজির এই হাদীসটা জানতাম, তাহলেই বুঝতে পারতাম, ইসলাম সত্য। ইসলামের নবী সত্য। আমার দোস্তকে পাওয়ার পর ইসলামের সত্যতার আকীদা আরও পোক্ত হয়েছে। যতবার আমার জানপরান দোস্তের সাথে কথা বলি, ততই আল্লাহর প্রতি মহব্বত আগের তুলনায় বৃদ্ধি পায়। পেয়ারা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি মহব্বত বেড়ে যায়।
.
আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ফয়দা করেছেন। আমাদের আদি পিতামাতা আদম ও হাওয়া আ.-কে সৃষ্টি করেছেন। আমাদের জন্য বিয়ের মতো অপূর্ব একটি ব্যবস্থা চালু করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা যদি এই বিয়ের বিধান না দিতেন, তাহলে আমি কি বিয়ে করতাম? আমি কি আমার দোস্তকে পেতাম?
.
আল্লাহর রাসূল কতবড় মানুষ। তারপরও তিনি আম্মাজানগনের সাথে কী সুন্দর মহব্বতপূর্ণ দাম্পত্য জীবন কাটিয়ে গেছেন। আমাদের জন্য অনুপম আদর্শ রেখে গেছেন। আমাদের সামনে জীবন্ত নমুনা কায়েম করে গেছেন। বিবির প্রতি অন্যায় আচরণ করতে গেলেই নবীজির কথা মনে পড়ে। তিনি কি বিবিগনের সাথে কখনো কঠোর ব্যবহার করেছেন? আমি তাঁর উম্মত। তাকে অনুসরণ করা আমার উপর ফরয। আমি কীভাবে তার উম্মত হয়ে বিবির সাথে রূঢ় আচরণ করতে পারি?
.
মসজিদের অদূরে একটা কালভার্ট আছে। সেটার নিচ দিয়ে তিরতির করে পানি বয়ে যাচ্ছে। খোকা খোকা মাছ নাচতে নাচতে ¯্রােতের কোলে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। দু‘জন পা ঝুলিয়ে কিনারায় বসে বসে পোনাপুনিগুলোর খুনসুটি দেখছি। ভাবী ফোন করলেন। কী ব্যাপার?
-আমি সাইকেল চালিয়ে মাদরাসা থেকে ফিরি। ভীষণ গরম পড়ছে। ‘মাইওলা’ বারবার জানতে চাচ্ছে, ঘেমে গেছি কি না। মাদরাসা থেকে ফিরে গোসল করেছি কি না? ফ্রিজ তো নেই, কল থেকে ঠা-া পানি এনে খেয়েছি তো? পকেটে টাকা আছে? দোকান থেকে কিছু এনে খাওয়ার মতো? বড়ভাই কান্নাভাঙা গলায় বলেন,
-জি¦ না, টাকা নেই।
টাকা নেই শুনে দোস্ত ওপারে কেঁদে দিল। তার হাতেও বোধ হয় টাকাপয়সা নেই। থাকলে পাঠানোর ব্যবস্থা করতো। মাসের শুরু তো। গতমাসে পাটি-চাটাই যা বানিয়েছে, সেটা বিক্রি করে, সংসারে লাগিয়ে ফেলেছে। আরও কয়েকটা চাটাই বিক্রির অপেক্ষায় আছে। ছেলেরা বৃহস্পতিবারে মাদরাসা থেকে এলে ‘চালনা’ বাজারে বিক্রি করবে। তখন হাতে দুটো পয়সা আসবে। তখন পর্যন্ত কিছুই করার নেই।
.
গ্রামের মানুষ বিবিকে অনেক সময় আদর করে ‘মাইওলা’ বলে থাকেন। ভাইও কখনো কখনো ভাবীকে মাইওলা বলেন। একদিন বললেন,
-দোস্ত, মাইওলা মানে জানেন তো?
-মাইওলা মানে মেয়েমানুষ।
-সেটা ঠিক আছে। কিন্তু শব্দটার ‘তাহকীক’ শুনে নিন। দোস্তের মতো ‘মাইওলা’-ও দুটি শব্দ দিয়ে গঠিন। মাই মানে ‘ম্যাঁয়- আমি। ওয়ালা-অধিকারী। মাইওলা মানে যে আমার অধিকারী। আমাকে যে অধিকার করে নিয়েছে। আমার দোস্ত সত্যি সত্যি আমার ‘মাইওলা’। বিয়ের পর যত দিন গড়িয়েছে, ততই তিনি আমাকে অধিকার করে গেছেন। একসময় দেখা গেছে আমি আর আমি নেই। আমি আমার ‘দোস্ত’ হয়ে গেছি। প্রকৃত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এমন হওয়া উচিত বলে মনে করি। একে অপরের পরিপূরক। এটা আমার কথা নয়। আল্লাহর কথা,
هُنَّ لِبَاس لَّكُمۡ وَأَنتُمۡ لِبَاس لَّهُنَّۗ
তারা তোমাদের পোষাক, তোমরাও তাদের পোশাক (বাকারা ১৮৭)।
.
ভাই ফোন রেখে আমার দিকে ফিরে বললেন, এভাবে মহব্বত দেখালে, কেমন লাগে বলুন দেখি। বিয়ের আগে আব্বার উপর মনে কষ্ট ছিল। প্রথম প্রথম ভাবতাম, আম্মু যেখানে বিয়ে ঠিক করে গিয়েছিলেন, সেখানে বিয়ে হলেই বোধ হয় ভালো হত। জীবনটা সুখের হত। ভুলটা ভাঙতে দেরি হয়নি। আব্বার জন্য এখন মনখুলে দোয়া আসে। গল্পের গন্ধ পেয়ে কৌতুহলী মন খলবল করে উঠল,
-কোথায় বিয়ে হওয়ার কথা ছিল?
-আমার ছোটখালার মেয়ের সাথে।
-কেন হল না বিয়েটা?
-সে অনেক লম্বা কাহিনী। মাগরিবের সময় হয়ে গেছে। পরে আরেকদিন সময় করে বলবখন।
.
বড়ভাইয়ের সাথে গ্রামের আর দশটি শিশুর মাঝে খুব একটা পার্থক্য নেই। মাদরাসা ছুটি থাকলে, পুরোদস্তুর গ্রাম্যকিশোর বনে যান। বর্ষা এলে, শিশুদের সাথে মিলে পুকুরে দাপাদাপি করেন। পুকুর পাড়ে কয়েকটা ঝুঁকেপড়া গাছ আছে। সেটা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এপার-ওপার সাঁতরান। ছোটদের সাথে প্রতিযোগিতা করেন। ডুবসাঁতার দিয়ে মাছ ধরেন। পাশের বাড়ি থেকে জাল এনে মাছ ধরেন। সেই মাছ পুকুরপাড়ে চুলা কেটে রান্না করেন। ‘জোলাভাতির’ মাছতরকারি খাওয়ার জন্য বাড়ির মেয়েরাও বাটি পাঠিয়ে দেয়। মাছের পেটে ডিম থাকলে, সেটাকে ছেড়ে দিতেন। ডিমঅলা মাছ ধরতে চাইতেন না। ক্বচিৎ ধরলে, লাল-লাল ডিমের ঝোল যা রাঁধতেন না, আহা অমৃত অমৃত!
.
বড়ভাই ‘জাতে যেমনই হোন, তালে পুরোপুরি ঠিক। যতই হাসিফুর্তি করে মাছ ধরেন, শরীকানার পুকুরের মাছ খাওয়ার আগেই, হিশেব করে দাম পরিশোধ করার চেষ্টা চালান। মালিকপক্ষ আধহাত লম্বা জিভ করে ‘তৌবাস্তাগফেরোল্লাহ’ বলতে বলতে পিছু হটেন। তারা পিছু হটলেও, ভাই হটার বান্দাই নন, তিনি পকেটের টাকা খরচ করে, মাছের পোনা ছাড়েন পুকুরে। বাজার থেকে মাছের খাবার এনে ছাড়েন। প্রতিদিন কিছু সময় মাছের সাথে কাটান। একটাকার মুড়ি কিনে, বিকেলে পুকুরপাড়ে এসে বসেন। জলে মাছপোনা, ডাঙায় মানুষপোনা ভাইকে ঘিরে ধরে। জলেডাঙায় পোনাপুনিদের হুটোপুটি দেখার মতো দৃশ্য হয়। ভাইকে তখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের মতো লাগে। নিজের হাতে মাছের আধার ছিটিয়ে দিচ্ছেন। ছেলেমেয়েদের হাতেও মুুড়ি-মুড়কি তুলে দিচ্ছেন। কচিকাঁচারা যেন সাতরাজার ধন হাতে পেয়েছে। মাছেরাও ভাইকে চিনে গিয়েছে। তিনি পুকুর পাড়ে গেলেই মাছেরা ছলবল করে ছুটে আসে।
.
বৃষ্টির দিন হলে, রাতজেগে চলে ডালাশিকার। বড়ভাইয়ের কাছে কয়েক প্রকারের ‘কোঁচ’ জমা আছে। মসজিদের অদূরে ছোট্ট কালভার্ট। বৃষ্টির পানি সোঁ সোঁ করে তীরবেগে ছোটে। বানের পানিতে বড় বড় মাছ নাচতে নাচতে জলার পানিতে মুক্তপ্রাণে বেড়াতে যাওয়ার পথে, কোঁচবিদ্ধ হয়ে শাহাদাত বরণ করে। মাছধরা শেষ হলে শুরু হয় ভাগবাঁটোয়ারা। কেউ কাঁচামাছ নিতে চাইত না। বাড়ির বধূরা চাইত, বড়ভাইয়ের হাতের রান্না খেতে। তাদের কথা একটাই, হুজুরকে আমরা প্রতিদিন রেঁধে খাওয়াই, হুজুর আজ আমাদেরকে রেঁধে খাওয়াবেন। বড় এক হাঁড়িতে মাছরান্না চড়ে। ভাই, রান্না চড়িয়ে দিতে তাহাজ্জুদ পড়তে চলে যান। শাগরেদদের নিয়ে যিকির শেষ করে, আবার রান্না দেখতে আসেন। ততক্ষণে মাছের মনকাড়া সুুুুবাসে চারপাশ মুখরিত। ঘরে ঘরে সাজসাজরব। আজ মসজিদে মাছরান্না হচ্ছে। সবার ভাগে কিছু না কিছু পড়বে।
.
তালের দিন এলে, রাতগুলো হয় বেশ উপভোগ্য। মসজিদের মালিকানায় বেশক’টা তালগাছ। ভাই রাতজেগে তাল পাহারা দেন। দুম করে তালপড়ার শব্দ হলেই, ছোট্টশিশুর মতো দৌড়ে যান। আরও অনেকে ছুটে আসে। কে কার আগে যেতে পারে, তীব্র প্রতিযোগিতা চলে। ফজরের পর মক্তবে কেউ পড়া ভালো করে শোনাতে পারলে, ভাগে জোটে একটা সুপক্ক নধর টসটসে তাল। তালের দিনে, খোকা-খুকুদের পড়ালেখার জোশ বেড়ে যায়। পড়া ভাল পারলেই যে ভাগে তাল পড়বে! পড়া না পারলে পিঠে ‘তাল’ পড়ার আশংকাও থাকে অবশ্য। মৌসুম শেষে দেখা যেত, প্রায় প্রতিটি খোকাখুকুর ভাগেই কমপক্ষে একটা করে তাল পড়েছে। ভাই কৌশলে সবাইকে একদিন করে পাস করাতেন। কোনও ঘরে কয়েকজন থাকলে, তাদের ভাগে একটাই জোটে।
.
স্কুল বা মাদরাসা ছুটি থাকলে, নানারকমের খেলার আয়োজন করেন। প্রায় সব খেলাতেই বড় ভাই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। একেবারে ছোটশিশুর মতো হয়ে যান। পুকুরে সাঁতার প্রতিযোগিতা করেন। দুরন্ত কিশোরের মতো হেলেপড়া আমগাছ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুবসাঁতার দেন। কয়েকটা নৌকা বানিয়ে মসজিদের পুকুরে ভাসিয়ে রেখেছেন। প্রতি জুমাবারে নৌকাবাইচ করেন। নিজেও একটি ডিঙ্গিতে লগি নিয়ে উত্তেজনাময় ভঙ্গিতে প্রতিযোগিতায় নামেন।
.
ভাইয়ের ছাত্ররা বড় হয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন মাদরাসায় পড়াশোনা করছে। কেউ কেউ শিক্ষকতাও করছে। মাদরাসা ছুটি হলে, সবাই বাড়ি ফেরে। প্রায় সকলেই প্রথমে বাড়ি না গিয়ে, তাদের হুজুরের সাথে দেখা করে। যেন তারা বাড়িতে আসেনি। এসেছে হুজুরের সাথে দেখা করতে। হুজুরের সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে। পড়াশোনার উন্নতি-অগ্রগতির কথা বলে। নতুন কী শিখেছে, সংক্ষেপে তার বিবরণ পেশ করে। তারপর বাড়িমুখো হয়।
.
দুপুরে-রাতে খাওয়ার সময়, সবাই যে যার বাড়ি থেকে ভাত-তরকারি নিয়ে আসে। সবাই মিলে এলাহি ভোজ হয়। বিরাট দস্তরখানা পড়ে। বড় বড় প্লেট আছে। লঙ্গরখানা বসে যায়। কখনো আরবের মতো পরিস্কার প্লাস্টিকের সুফরা (দস্তরখানায়) সবার ভাত-তরকারি ঢেলে দেয়া হয়। তারপর হয় একযোগে হামলা। সে এক দেখার মতো দৃশ্যই বটে। স্তূপীকৃত রাশিরাশি ভাতের পাহাড় মুহূর্তের মধ্যে নেই হয়ে যাচ্ছে।
.
রাতে শোয়ার সময়, সবাই একটা করে বালিশ নিয়ে হাজির। এলোপাথারি বালিশের পর বালিশ। এস্তেমার মাঠের মতো সারি সারি মাথা আর পা। শুয়ে শুয়ে কখনো কুরআনের আলোচনা, কখনো হাদীসের, কখনো ফিকহের, কখনো উসূলে ফিকহের, কখনো আকীদার, কখনো বিশ^পরিস্থিতির। ছোট্ট কুটিরে খাঁতাখাঁতি যাঁতাযাঁতি করে শুলেও, আরামের সুখনিদ্রা যেতে কারও বিন্দুমাত্র কসরৎ করতে হয় না।
.
ঘুমুতে যত দেরিই হোক, তাহাজ্জুদের সময় হলে, সবাই মিলে নামায, যিকিরে মশগুল হয়ে পড়ে। তারপর মনপ্রাণ উজাড় করে আল্লাহর দরবারে রোনাজারি (কান্নাকাটি)। বড়ভাই দু‘আ করেন। ছাত্রশিষ্যরা কান্নাভেজা আমীন বলে। এসব দিনে এলাকার ময়-মুরুব্বীও কেউ কেউ শেষরাতের ইজতিমায়ী আমলে জুড়েন। বাড়ির মা-বোনেরা খাস দোয়া চেয়ে সনির্বন্ধ অনুরোধ পাঠান। ফজরের পর ব্যয়াম, সাঁতার, সাইকেল, দৌড়। একসময় একটা। মওসুম বুঝে আয়োজন মাদরাসার তালিবে ইলমদের বাড়ির সময়টুকু পুরোই অর্থময় হয়ে ওঠে।
.
মাগরিবের পর বসে বিশেষ মজলিস। সবাই মাদরাসায় কোনও মাসয়ালা না বুঝতে পারলে, প্রশ্নটা খাতায় লিখে রেখে দেয়। বাড়ি এসে, সব প্রশ্নের উত্তর বড়ভাইয়ের কাছ থেকে জেনে নেয়। ভাই প্রথমে নিজে উত্তর দেন না। উপরের জামাতের কাউকে উত্তর দিতে বলেন। না পারলে নিজে বলে দেন। শুরু থেকে দাওরা হাদীস পর্যন্ত প্রতিটি কিতাব, ভাইয়ের প্রায় মুখস্থই বলা যায়। অনেক বছর পড়াতে পড়াতে, সব কিতাব একেবারে আয়নার মতো হয়ে গেছে। সমাধান দিতে খুব একটা বেগ পেতে হয়েছে।
.
সবাই বাড়ি এলে, আরেকটা কাজ করেন। কিতাবী সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে, পালাক্রমে একদিন একজনের বাড়িতে মাহফিলের আয়োজন করেন। সবাই সবার বাড়িতে, চার-পাঁচ মিনিট করে বয়ান করে। পর্দার ওপাশে মা-বোনেরা থাকেন। বেশ ফায়েদা হয় এই আয়োজনে। মা-বোনেরা প্রশ্ন করারও সুযোগ পান। নিজের ছেলেকে দিয়ে, নিজের ভাই বা স্বামীকে দিয়ে প্রশ্ন পাঠানোর নিয়ম। বড়ভাই সাধ্যমতো উত্তর দেন।
.
সবচেয়ে আকর্ষণীয় হয়, হামদ-নাত ও ইসলামী সংগীতের আয়োজনটা। প্রতি ছুটিতে একটা গযলের জলসা হয়। মহিলারা বাড়িতে বসেই যাতে শুনতে পারে, সেজন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা থাকে। একদিন সম্মিলিতভাবে ওয়াজের ব্যবস্থাও থাকে। ওয়াজের চেয়ে সংগীতের দিকেই সবার ঝোঁক বেশি। সেদিন হিন্দু নারী-পুরুষও ভীড় জমায়। তালিবে ইলমরা যে যার মাদরাসা থেকে সুন্দর সুন্দর হামদ-না‘ত শিখে আসে। কেউ কেউ স্বরচিত ইসলামী সংগীতও পরিবেশন করে। আশেপাশের প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্ররাও পরিবেশনের সুযোগ পায়। কেরাত প্রতিযোগিতাও হয়। স্কুলের ছেলেদের জন্য ক্বেরাত প্রতিযোগিতায় আকর্ষণীয় পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকে।
.
ভাই গ্রাম আর মসজিদ ছেড়ে কোথাও যেতেই চান না। একমাত্র ভাবীর কাছেই যান। বাকি সময়ের পুরোটাই মসজিদ আর এলাকার ফিকিরে কাটে। সবসময় বলেন,
‘আল্লাহ আমাকে কত সুখ দিয়েছেন। গ্রামে ছোট ছোট কিতাব পড়াই। শহরে যেতে বলেছিল। ভাল লাগে না। গ্রামে নিরিবিলিতে থাকতে ভাল লাগে।’
.
প্রতি ছুটিতে বড়ভাই গ্রামের পুকুরগুলোতে মাছ জিয়োতে দেন। পুকুর পাড়ে ফল-ফলাদির গাছ লাগান। গ্রামের রাস্তার দু’পাশে গাছ লাগান। ছাত্রদের নিয়ে সেসবের পরিচর্যা করেন নিয়মিত। ঢাকায় যারা পড়ে, তাদেরকে বলে দেন, নতুন কোনও গাছ পেলে নিয়ে আসতে। গ্রামজুড়ে নানা ঔষধি গাছের ছড়াছড়ি। প্রায় সব ধরনের ফল গাছ আছে। প্রতি বাড়ির পুকুর পাড়ে দশ-এগার প্রকারের ফলগাছ। অনেক ফলগাছ এমন আছে, আশেপাশের গ্রামের মানুষ জীবনে চোখেও দেখেনি। এই গ্রামের দেখাদেখি অন্য গ্রামেও ফলফলাদির চাষবাষ বেড়ে গেছে। মাছচাষেও জোয়ার এসেছে। ভাইয়ের বরকতময় ছোঁয়ায়, গ্রামটা ফল-শষ্যে, মাছ-তরকারিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে।
.
বড়ভাইয়ের বইকিতাব সংগ্রহ করার বাতিক আছে। নেশা বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত। ছাত্ররা বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বিদেশে আছে। সবার কাছে বইকিতাব চেয়ে নেন। যাদের বইসংগ্রহের নেশা থাকে, তারা সাধারণত বই হাতছাড়া করতে চান না। চাইলেই দিয়ে দেন। কেউ ফেরত দেয়, কেউ দেয় না। সমস্যা নেই, আবার সংগ্রহ করে নেন। তার কথা হল, আমি তো বইটা একবার পড়ে নিয়েছি। এবার অন্যরা পড়–ক। সকালের মক্তবে ছেলেরা পড়তে এলে, তালিকা ধরে ধরে প্রত্যেক ছাত্রকে একটা বই দেন। একসপ্তাহ পরে বইটা ফেরত নিয়ে নেন। বইয়ের জন্য আলাদা হাজিরাখাতা বানিয়েছেন। এমন করে বানানো, নামের পাশে বইয়ের নাম লেখা যায়। জানতে চাইলাম,
-এভাবে বই দিলে কেউ পড়ে?
-আমার কাজ হল চেষ্টা করা। ছাত্রদেরও উদ্ব্দ্ধু করি তারা যেন তাদের মাকে-বোনকে বইটা পড়তে বলে। আশেপাশের প্রায় সবাই আমর ছাত্র বা ছাত্রী। বেশ আর কম সবারই অক্ষরজ্ঞান আছে। একদম বৃথাও যায় না। কিছু না কিছু তো পড়া হয়ই। তাতেই পরিশ্রম সার্থক।
.
ভাইয়ের একটা কাজ বেশ অবাক করত। তিনি আসরের পরে, কখনো ‘মিনিটমাদরাসা’-এর কার্যক্রম স্থগিত রেখে, গ্রামের সবচেয়ে গরীব গেরস্থদের বাড়িতে হাজির হন। সাথে থাকে ছোটখাট হাদিয়া। হাদিয়া বলতে, হয়তো আধাকেজি চাল, অথবা একপোয়া মসুর ডাল, অথবা এককেজি আলু, কখনো একপোয়া পেঁয়াজ। এধরনের সাংসারিক টুকিটাকি সদাই হাদিয়া হিশেবে নিয়ে যেতেন। এমন অদ্ভুত হাদিয়া দিতে আর কাউকে দেখিনি। গ্রামে যারা ভিক্ষুক আছে, সবার তালিকা ভাইয়ের কাছে আছে। মাসে অন্তত একবার হলেও, তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা করেন। সাথে কিছু হাদিয়া নিয়ে যান। তাদেরক উপায়-উপার্জনের পথ বাতলানোর চেষ্টা করেন। কয়েকজনকে তিনি ভিক্ষবৃত্তি ছেড়ে, নিজের উদ্যোগে স্বাবলম্বী হতে উৎসাহিত করতে পেরেছেন। গরীব গেরস্থ বাছাইয়ে, মুসলিম বা হিন্দুর মাঝে কোনও বাছবিচার করতেন না।
.
মাদরাসার বড় বড় কিতাব পড়ালেও, বড়ভাই প্রতিবছর একেবারে নিচের জামাতে একটা কিতাব চেয়ে নেন। কখনো নূরানীখানায়। কখনো দোয়াযদাহমের উর্দু কায়দা। কখনো ইয়াযদাহমের ফার্সি কী পহেলী। ভাইয়ের চিন্তা পরিস্কার, সবাই বড় বড় কিতাব পড়াতে একপায়ে খাড়া। উপরের কিতাব পড়ানো সহজ। ছোটদের কে পড়াবে? তাদেরকে পড়ানো কি লজ্জার? আমার কাছে মনে হয়, বুখারি-মিশকাত পড়ানোর চেয়ে ‘বাকুরাতুল আদব’ পড়ানো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বেশি কঠিন। উপরের কিতাবে তেমন কোনও মেহনত নেই। চ্যালেঞ্জ নেই। প্রথম এক-দুই বছর হয়তো একটু মুতালা‘আ করতে হয়, পরে আর খুব বেশি একটা মুতালা‘আর প্রয়োজন হয় না। উপরের জামাতে ‘দরস’ করা আর নিচের জামাতে দরস করার সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে, উপরের জামাতে শুধুই পড়ানো। একটা সবক গড়গড় করে উগরে দিয়ে চলে আসা। কিন্তু নিচের জামাতে গড়গড় করে উগরে দিয়ে আসার কিছু নেই। ছোটদের সামনে বসলে, সারাক্ষণ তটস্থ থাকতে হয়। প্রতি মুহূর্তে সতর্ক থাকতে হয়। একচোখ কিতাবে রাখলে, আরেক চোখ ছাত্রদের দিকে রাখতে হয়। পড়া ধরছে কি না, পড়া বুঝতে পারছে কি না, ছাত্রের চেহারা দেখে আঁচ করে নিতে হয়। সেমতে ব্যবস্থা নিতে হয়। প্রতিনিয়ত তৎপর থাকতে হয়। একটু বেখেয়াল হলেই দেখা যাবে, দুষ্ট-অমনোযোগী তালিবে ইলম কিতাব ছেড়ে অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যোগ্য ওস্তাদগনকে উপরের কিতাব দেয়া হয়। তাদেরকে উপরের পাশাপাশি নিচের কিতাবও দেয়া উচিত। তারা পড়িয়ে পড়িয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো দরকার নয়?
.
ভাইয়ের মতো এমন ওস্তাদভক্ত ছাত্র আর দেখিনি। কথায় কথায় ওস্তাদের কথা বলেন। ওস্তাদের জন্য দোয়া করেন। ওস্তাদগনের কথা বলতে গেলে তার চোখে পানি চলে আসে। ভাইয়ের সাথে কথা বলতে বসলে, মোটাদাগে তিনটি বিষয় ঘুরেফিরে আসে,
১: আল্লাহর কথা। কুরআনের কথা। তাফসীরে জালালাইন, তাফসীরে বয়যাবী, তাফসীরে জাওয়াহিরুল কুরআন। তাফসীরে কুরতুবী আর তাফসীরে মা‘আরিফুল কুরআনও তার হাতের নাগালে থাকে। যখন তখন তাফসীরে কুরতুবী খুলে বসেন।
২: নবীজি সা.-এর কথা। মেশকাত শরীফের সুত্র ধরে। ফাঁকে ফাঁকে আসে ওস্তাদগনের কথা।
৩: ভাবীর কথা। এই প্রসঙ্গ উঠলেই, ভাবীর কোনও-না-কোনও ঘটনা বলবেনই। বিবিকে ভালোবাসা মানেই তো আল্লাহকে ভালোবাসা। আল্লাহর রাসূলকে ভালোবাসা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল না বললে কি আমি বিবিকে ভালোবাসতাম? এই একটা মানুষের ভালোবাসার মাধ্যমে আমি আল্লাহ ও রাসূলকে আরও বেশি ভালোবাসার প্রেরণা পাই। যতবার বিবির সাথে কথা বলি, আল্লাহর প্রতি মনটা আরও বেশি শোকরগুজার হয়ে ওঠে। ইমাম বুখারী রহ. প্রতিটি হাদীস লেখার আগে ওজু-গোসল করে দুই রাকাত নামায পড়ে নিতেন। আমারও প্রতিবার ‘জানের দোস্তের’ সাথে কথা বলার পর, দুই রাকাত সলাতুশ শোকর আদায় করতে ইচ্ছে করে। সময় থাকলেও আদায় করিও।
.
আচ্ছা, এই তাহলে ঘটনা। তাইতো বলি, ফোন রেখেই কেন নামাজে দাঁড়ানো হয়? এখন তো কোনও নামায নেই? ভাই বলেন, আমার দোস্তের মতো এত দামী আর বড় নেয়ামত পাওয়ার যোগ্য আমি নই। করুণাময় অশেষ দয়া করে, নেয়ামত দিয়েছেন। আমি যদি শোকর আদায় না করি, নেয়ামতের না-শোকরি হয়ে যাবে না,
لَىِٕن شَكَرۡتُمۡ لَأَزِیدَنَّكُمۡۖ وَلَىِٕن كَفَرۡتُمۡ إِنَّ عَذَابِی لَشَدِید
তোমরা যদি সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা আদায় করো, আমি তোমাদেরকে আরও বেশি দেব, আর যদি অকৃতজ্ঞতা কর, তবে জেনে রেখ, আমার শাস্তি অতি কঠিন (ইবরাহীম ৭)।
.
আমার ‘হাকীকী দোস্ত’ আমার জীবনে আসার পর থেকে, আমি শুধু বরকত আর বরকত দেখতে পাচ্ছি। সবচেয়ে বড় কথা, আমার চিন্তার গুনাহ একেবারে নেই হয়ে গেছে বললে, আশা করি ভুল বলা হবে না। একটু কথা বললেই ভাইয়ের মুখে মেশকাত শরীফের হাদীস চলে আসে। এখন বলে উঠলেন, বিয়ে হল গুনাহের এন্টি ভাইরাস।
يا مَعْشَرَ الشَّبابِ، مَنِ اسْتَطاعَ الباءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ، فإنَّه أغَضُّ لِلْبَصَرِ وأَحْصَنُ لِلْفَرْجِ،
হে যুবক সম্প্রদায়, তোমাদের যাদের মধ্যে বিবির ভরণপোষণের সামর্থ আছে, তারা শিঘ্রি বিয়ে করে ফেলো। কারণ বিয়ে তোমাদের দৃষ্টিকে পাপদিক থেকে র্বাঁচিয়ে রাখবে। লজ্জাস্থানকে গুনাহ থেকে হেফাযত করবে (বুখারী শরীফ ১৯০৫)।
.
পেয়ারা নবীজি সা. এই হাদীসে উম্মতের যুবকশ্রেণীকে বিয়ের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। যার বিয়ের সামর্থ আছে, সে বিয়ে না করলে, তার দ্বীন অপূর্ণ থেকে যায়। বিয়ে মানবজীবনের পূর্ণতার প্রতীক। বিয়ে মানবপ্রকৃতির স্বাভাবকি চাহিদা। পানাহার যেমন প্রাণীর জৈবিক চাহিদা, বিবাহও তেমিন। শরীয়ত মানুষকে যেমন আল্লাহর ইবাদত করতে বলে, তদ্রƒপ বিয়েও করতে হবে। বিয়ের মাধ্যমে আল্লাহর অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়।
.
ভাইকে আলাভোলা মনে হলেও, ভাই তাকওয়ার ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন থাকেন। প্রকৃত মুমিন এমনি হয়ে থাকেন। ভাই বলেন,
‘এখানে যখন প্রথম প্রথম জায়গীর থাকতে আসি, তখন টগবগে তরুণ। বিয়ে হয়েছে আরও পরে। কিছুদিন পর বিয়ে হল। নতুন বিয়ে হলেও বিবির সাথে ‘আশনাই’ তখনো জমাটি ‘খুশবাই’ ছড়াতে শুরু করেনি। গুনাহের নানা উপকরণ চারপাশে মজুত। এখনকার মতো ফোন ছিল না যে, চুটিয়ে চুরিয়ে বিবির সাথে রাত-বিরেতে প্রেম করব। আল্লাহ হেফাযত করেছেন। বিপদ এখনো পুরোপুরি কাটেনি। এখনো ছাত্রীরা বাপের বাড়ি এলে, আমার সাথে কথা বলার জন্য ‘হুজরায়’ চলে আসে। আমি একা বসে আছি। পানিপড়া নেয়ার ছুতোয় হুট করে হুজরায় ঢুকে পড়েছে, এমন ঘটনা অনেকবার ঘটেছে। মারমুখো ভঙ্গিতে জানতে চাই,
-কেন এসেছিস?
-পানি পড়া আর বাবুর জন্য দোয়া নিতে।
-এসবের জন্য তোকে আসতে হবে কেন। জামাই বা বাপ-ভাইকে পাঠা।
-আমি আপনার ছাত্রী। ওস্তাদের কাছে আসলে সমস্যা কিসের। আপনার কিছু লাগবে কি না, দেখতে এসেছি।
-আর কী লাগবে না লাগবে, সেটা ঘরে বসে ভাববি। এখানে আসার দরকার কী। আর এখন বিয়ে হয়েছে। স্বামীর কী লাগে না লাগে, সেদিকে খেয়াল রাখ। স্বামীর খেদমত করে তার দোয়া নে। দোয়ার জন্য আমার কাছে আসতে হবে না। ঘরে বাবা-মা আছেন। জামাইর বাড়িতে জামাই আছে, শ^শুর-শাশুড়ী আছেন। তারা তোর জন্য দোয়ার ভা-ার।
.
ভাই হুজরার দরজা-জানালা চব্বিশ ঘণ্টা হাটপাট করে খোলা রাখেন। এখন বুঝতে পারলাম কেন এটা করেন। পাশেই রাস্তা। সবসময় কেউ না কেউ আসছে-যাচ্ছে। যেতে আসতে হুজরার অন্ধকার কোণ পর্যন্ত পথিকের নজরে পড়ছে। লুকোছাপার কিছু নেই। ভাইয়ের কাছে যাওয়ার পর এভাবে খোলা দরবারে বসে থাকতে একটু লজ্জা লজ্জা লাগত। পরে অভ্যেস হয়ে গেছে। ভাই তো আরও খোলামেলা। উদোম গায়ে রোমশ শরীরে বিকট স্বরে নাক ডেকে গররর করে ঘুমুচ্ছেন। কোনও বিকার নেই। যস্মিন দেশে যদাচার। আমিও ভাইয়ের অনুকরণে একেবারে ‘একশতে একশ’ হয়ে বসে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।
.
ভাইয়ের দরজার তালাও নেই। তালার কী প্রয়োজন? চোরের হাত থেকে বাঁচার জন্য? চোর এখানে এসে কী পাবে? দামী বলতে একতাক কিতাব। মাদরাসায় যাওয়ার সময়ও দরজাটা একটু ভেজিয়ে দিয়ে চলে যান। বাতাস এসে দরজা আবার খুলে দেয়। পুরোদিন এভাবে থাকে। যাদের স্কুল এগারটার পর, তারা এখানে বসে বসে বাড়ির কাজ করে। মাঠের কাজের ফাঁকে গেরস্তরা হুজরায় এসে পানি খায়। বউরা এখানে খাবার রেখে যায়, জমির কাজ শেষে করে এখানে এসে ভাত খেয়ে যায়। হুজুরের মন যেমন সদা উন্মুক্ত, ঘরের দ্বারও অবারিত। বহুদিন পর এমন একজন মানুষের দেখা পেলাম, যার ঘরে তালার প্রয়োজন হয় না।
.
প্রতি বৃহস্পতিবার জোহরের আগেই ঘণ্টা শেষ হয়ে যায়। ভাইয়ের শেষ ঘণ্টা খালি। মসজিদে এসে যাতে আসর পড়াতে পারেন, সেজন্য এই ব্যবস্থা। বৃহস্পতিবারে ঘণ্টা শেষ করেই সাড়ে এগারটার দিকে ভাই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়েন। মাদরাসার সবাই জানে, তিনি এমন ব্যস্তসমস্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছেন। তাই এই সময়ে কেউ ভাইকে ঘাঁটায় না। কেউ কথা বলতে এলে, ভাই ঝাঁজিয়ে ওঠেন। শিক্ষকদের কেউ দুষ্টুমি করে এটাসেটা বলে ভাইকে বাধা দিয়ে দেরি করিয়ে দিতে চান। কোনও বাধাই ভাইকে আটকে রাখতে পারে না। দুদ্দাড় করে সব ছিঁড়েখুঁড়ে বেরিয়ে আসেন। কখনো রিকশায়। কখনো টমটমে। বেশিরভাগ সময় হেঁটে। এক বৃহস্পতিবারে ভাই সাথে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক জোরাজুরি করলেন। যেতে খুব ইচ্ছেও করছিল। টোনাটুটির মিষ্টি সংসার দেখার লোভ কেইবা সামলাতে পারে? তবুও মনকে কষে বাঁধলাম। ভাইকে নিরামিষ মুখে বললাম,‘কাবাব মে হাড্ডি হতে চাই না’। ভাই ভীষণ খুশি হলেন। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন যেন।
.
বৃহস্পতিবারে শেষ দরসে পড়ানো শেষ করে কিতাব বন্ধ করতে না করতেই বাড়ির ফোন। ওদিকে যেন তর সইছে না। ভাবী জানেন কয়টা বাজে দরস শেষ হবে। ভাই কখন কিতাব বন্ধ করবেন। একেবারে কাঁটায় কাঁটায় কল। ভাবী এই কলটা করার জন্য গত একঘণ্টা ধরে মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছেন,
-হ্যালো, এই তো বেরিয়ে পড়েছি! কী? তাড়াতাড়ি করবো? জি¦ না, দোস্ত আজ যে তাড়াতাড়ি করা সম্ভব নয়! ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করুন। পকেটে যা আছে, তা দিয়ে কোনও রকমে টমটম ভাড়াটা হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি কিভাবে যাই? সিএনজি স্ট্যান্ডে গেলে, সহযাত্রীর অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে।
-দেরি হলে, রিজার্ভ করে চলে আসুন। এখানে এলে আমি ভাড়া দিয়ে দেব।
-এই শুনুন, আজ মনে করে ডিম আর মধু খেয়েছিলেন?
-খেয়েছি বাবা খেয়েছি। আজ সকালে গোসল করে সর্দি লেগে গেছে।
-আচ্ছা, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি পানি গরম দিয়েছি। একসাথে নামাজ পড়ব। পুঁটি মাছের কোপ্তা করেছি। সাথে আছে পেঁয়াজ কুঁচো দিয়ে মরিচ ভর্তা। হাতে আর টাকা ছিল না। জানতাম সিএনজি রিজার্ভ করতে হবে। তাই পুরো সপ্তাহ তরকারি না খেয়ে, টাকা বাঁচিয়েছি। আজ সকাল থেকে বড়শি বেয়ে মাছক‘টা ধরতে পেরেছি। গাছে মরিচ যা ছিল, সব তুলে এনেছি।
- আম্মা ঘরে আছেন না?
-আম্মু আজ বড় আপুর বাড়ি গিয়েছেন।
-মাঈশা?
-তাকেও তার দাদুর সাথে ফুফির বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। ঘর পুরোই খালি। তাড়াতাড়ি এসে পড়–ন।
ভাই ভীষণ আক্ষেপ নিয়ে বলেন,
‘আহা, যদি দু’টি ডানা থাকত!’
কোন মন্তব্য নেই